ড. মো. হুমায়ুন কবীর: এখন একটি বিষয়ে প্রায়ই কথা বলতে শোনা যায় আর সেটি হলো- পানি নিয়েই নাকি আগামীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে। সেটি হবে বললে ভুল হচ্ছে। আমার বিবেচনায় তা আসলে ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অথচ বিশ্ব-ভূগোলের তিন-চতুরাংশই পানি। পানিই জীবন। কারণ পানি ছাড়া কোন জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সেজন্য আজকে পৃথিবী ছাড়া যখন অন্য যেসব গ্রহ-উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজা হচ্ছে, তখন প্রথমেই দেখা হচ্ছে সেখানে কোন পানি রয়েছে কিনা। কারণ পানির অস্তিত্ব থাকলেই সেখানে জীবনের অস্তিত্বও থাকবে।
তিন-চতুরাংশ পানি থাকলেও সে পানি যেমন ব্যবহাযোগ্য নয়, তেমনই সুপেয় কিংবা স্বাদু পানির উৎসও সীমিত। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির একটি বিরাট অংশের উৎস হলো মুক্ত জলাশয় এবং প্রাকৃতিক নদ-নদী। বাংলাদেশের কথা যদি বিবেচনায় নেই তাহলে দেখা যাবে এটি একসময় নদীর প্রাচুর্যের কারণে নদীমাতৃক দেশের মর্যাদার আসনে ছিল। এখানে একসময় ছোট-বড় সাতশ নদ-নদী থাকলেও স্রতস্বিনী নদ-নদী ছিল ২৩০টির মতো। তারমধ্যে ৫৪টি নদ-নদীর সাথে আমাদের প্রতিবেশী দেশের সংযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের ভিতর সুচারুরূপে পানির প্রবাহ পেতে হলে সেসকল নদীর ভরা প্রবাহ থাকা আবশ্যক। কিন্তু দুয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি প্রবাহের ক্ষেত্রেই উজান থেকে ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনই একটি প্রেক্ষপটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নভেম্বর ২০১৬ মাসের শেষ সপ্তাহে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে পানি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ‘ওয়াটার সামিটে’ যোগ দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে তিনি শুধু এককভাবে বাংলাদেশের জন্য না ভেবে বিশ্ববাসীর বিষয়ে চিন্তা করে কল্যাণকর ৭ দফা একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। প্রস্তাবিত এসব এজেন্ডাগুলো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ সে এজেন্ডাগুলো হলো- ১. ২০৩০-এ পানি এবং বৃহত্তর টেকসই উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ ও বিনিময়ের গৃহীত নীতি অনুযায়ী জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকপর্যায়ে যেকোন উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পানি হবে অবিচ্ছেদ্য অংশ, ২. বিশ্বে পিছিয়ে থাকা লাখ লাখ মানুষ অথবা গ্রুপ যারা বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং স্যানিটেশন সুৃবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংকট মোকাবেলা করছে তাদের চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, ৩. জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখোমুখি দেশগুলোর বিপন্ন এলাকায় পানি সম্পর্কিত বিপর্যয়রোধে সহায়ক কাঠামো নির্মাণ জরুরি, ৪. অব্যাহত পানি সংকটের জন্য পানির ঘাটতির মূল কারণ নয়, তবে সুষম বণ্টনের জন্য আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির কার্যকর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ৫. কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ব্যাপকভাবে পানি ব্যবহার হচ্ছে। এজন্য সীমিত পানি ব্যবহার করে কীভাবে শস্য উৎপাদন করা যায়- এমন জাতের উন্নয়নে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটাতে হবে, ৬. আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আরো উন্নয়নে প্রতিটি দেশের মধ্যে একে অপরের ‘লাইট-হাউজ-ইনিশিয়েটিভ’ বিনিময় প্রয়োজন। বিশেষত উন্নয়ন এবং পানি সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও কৌশল বিনিময় করতে হবে এবং ৭. পানি সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জনে গবেষণা, উদ্ভাবনা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে একটি বৈশ্বিক তহবিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য বিষয়টিকে সেখানে গৌরবের সাথে তুলে ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্বের প্রশংসিত ধারাবাহিক যেসব ব্যবস্থা প্রহণ করে আসছে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে সম্মেলনে। বাংলাদেশ বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ঘাটতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মেকাবেলা করছে বাংলাদেশ। অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতার কারণে দিনদিন বাংলাদেশের ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এভাবে পানির প্রতি ন্যায্য হিস্যা সংরক্ষণপূর্বক সুপেয় পানির ব্যবহারসহ পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। শেখ হাসিনা এখন পরিবেশ বিষয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেজন্যই তিনি জাতিসংঘের পানিবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্যানেলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাছাড়া পরিবেশ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৫ সালে জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় থাকা অধিকতর দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের নেতা হয়েও তা নিজস্ব অর্থায়নে ও কৌশলে মেকাবেলার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠন করে কাজ শুরু করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আগেও ১৯৯৭ সালে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর জন্য যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন তা সর্বশেষ ২০১৫ সালের প্যারিসে গৃহীত হয়েছিল। তাই জলবায়ু বিষয়ে তাঁর যোকান উদ্যোগ কিংবা বক্তব্য বিশ্ববাসী খুব গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন ও বিবেচনা করে থাকে।
কাজেই এবারেও তিনি হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে পানি সম্মেলনে যে ৭ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে তা ইতোমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এসব বিষয়ে তাঁর বক্তব্য এবং এ সফরের সাফল্য তুলে ধরার জন্য রীতি অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। আগামীতে এসব প্রস্তবনা কার্যকরের জন্য গৃহীত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর এগুলো গৃহীত হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। কাজেই এবারের ওয়াটার সামিট সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ। আমরা এর ভবিষ্যৎ সাফল্য কামনা করি।
লেখক: ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়