মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান ভূঁঞা: যশোরে বেগুনের একটি মৌসুমে ১৮০ থেকে ২০০ দিনের মধ্যে চাষিরা ৫০ বারেরও বেশি কিটনাশক স্প্রে করেন। বেগুনে ৭০ ভাগ পর্যন্ত পর-পরাগায়ন হতে পারে। বেগুনের পরাগরেণু কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। পরিবেশকর্মী এবং কৃষকরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে, ইঃ বেগুন চাষ করলে ইঃ বেগুনের পরাগরেণু স্থানান্তরের মাধ্যমে একই পরিবারের অন্যান্য ফসল তথা উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্যের জিনগত পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে প্রকট করে তুলতে পারে।
বেগুন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ এবং ফসল বৈচিত্র্যের প্রিয় সবজি। নিকোলাই ভাভিলবের (১৮৮৭-১৯৪৩) মতে, বাংলাদেশ হচ্ছে বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থলের কেন্দ্র। ঢেঁড়স এবং বাঁধাকপির মতো দেশের গ-ি পেরিয়ে বেগুন বিশ্ববাজারে সমাদৃত হচ্ছে। কৃষকের বীজ সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের হুমকি, প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণারোপ, ভোক্তার পছন্দের সুযোগ না থাকা এবং পেটেন্টের প্রশ্নের সুস্পষ্ট সমাধান না করে ইঃ বেগুন অনুমোদন সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।
ইঃ বেগুন প্রযুক্তির বিশেষত্ব হলো কৃত্রিমভাবে তৈরি ব্যাকটেরিয়ার জিন বেগুন গাছে ঢুকিয়ে অপ নামক বিষ তৈরি করা হয়, যা শুধুমাত্র বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকাকে দমন করে। কর্তৃক তৈরি ড়ীরহ কাঙ্ক্ষিত পোকার লার্ভাতে ঢুকে পরিপাকতন্ত্রকে ফুটো করে দেয়। ফলে পোকাটি খেতে অক্ষম হয়ে অল্পদিনের মধ্যে মারা যায়। মূলত একটি কীটনাশক যা কখনোই ফলন বাড়াতে পারে না। শুধুমাত্র ফসলহানি কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
ইঃ বেগুন পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ এ সংক্রান্ত কোনো স্বাধীন গবেষণাপত্র নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইঅজও) বেগুনের চারটি জাত উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা এবং ইশ্বরদী-০০৬-এ ইঃ প্রযুক্তির সূচনা করেছে। ইঅজও মনে করে, ইঃ বেগুন চাষে ক্ষতিকারক ফল ও ছিদ্রকারী পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার কমে যাবে। সবারই জানা দরকার, বেগুনের ফলন কমার জন্য ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা ছাড়াও আরো প্রায় ৮টি রোগ এবং অন্যান্য বালাই দায়ী।
উল্লেখ্য যে, একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া যা শতকরা ৫০ ভাগ বেগুনগাছের মৃত্যু এবং শতকরা ৯০ ভাগ ফলন কমানোর জন্য দায়ী। যদি কৃষকরা ইঃ বেগুন চাষের অনুমোদন পায়, তবে কি কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে? বরং অন্যান্য বালাই দমনে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। গবেষণায় প্রমানিত যে, বেগুনের তিনটি জাত উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার প্রতি অনেকাংশে প্রতিরোধী, ব্যাকটেরিয়াল উয়িল্ট রোগ সহনশীল এবং ইশ্বরদী-০০৬ ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা, ব্যাকটেরিয়াল উয়িল্ট, জাব পোকা, মূলের গিট সৃষ্টিকারী কৃমি সহনশীল। বাংলাদেশের কৃষকরা দেশীয় জাতের বেগুন চাষে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকাকে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং ফেরোমন ফাঁদের মাধ্যমে সফলভাবে দমন করতে সক্ষম হচ্ছেন।
ঋঅঙ-এর তথ্যমতে, শতকরা ৭০ ভাগ বালাইনাশক ধানের রোগবালাই এবং বাকি ৩০ ভাগ আখ, আলু, আম, কলা এবং শাক-সবজির রোগবালাই দমনে ব্যবহৃত হয়। শুধুমাত্র শাক-সবজির উৎপাদনে কি পরিমাণ বালাইনাশকের প্রয়োজন, তার কে,নো সুস্পষ্ট তথ্য নেই। যশোরে বেগুনের একটি মৌসুমে ১৮০ থেকে ২০০ দিনের মধ্যে চাষিরা ৫০ বারেরও বেশি কিটনাশক স্প্রে করেন। কিন্তু এটাতো কেবল বেগুনের একক বানিজ্যিক চাষ এবং কীটনাশক কোম্পানিগুলোর অতিদ্রুত প্রসারের ফল। এই কারণে ইঃ বেগুনই আলোচিত সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হতে পারে না। বেগুনে ৭০ ভাগ পর্যন্ত পর-পরাগায়ন হতে পারে। বেগুনের পরাগরেণু কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। পরিবেশকর্মী এবং কৃষকরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে, ইঃ বেগুন চাষ করলে ইঃ বেগুনের পরাগরেণু স্থানান্তরের মাধ্যমে একই পরিবারের অন্যান্য ফসল তথা উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্যের জিনগত পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে প্রকট করে তুলতে পারে। ইঃ বেগুন চাষাবাদে পরাগায়নে ভূমিকা রাখে এমন কীট-পতঙ্গের বংশবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যদি ইঃ বেগুন অনুমোদন পায়, তাহলে দরিদ্র কৃষকরা এই ইঃ বেগুনের বীজ কিনতে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন এবং উচ্চমূল্যে বীজ কিনতে বাধ্য হবেন। এর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা ছাড়া অন্য কারণে বেগুনের ফসলহানি ঘটলে কৃষক সর্বশান্ত হয়ে পড়বেন। ক্রমাগত ইঃ বেগুন চাষে ইঃ ঃড়ীরহ এর ৎবংরংঃধহঃ তৈরি হতে পারে, যার ফলে কীটনাশক ব্যহারের মাত্রা পূর্বের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যাবে। বেশিমাত্রার কীটনাশক ব্যবহার মাটি দূষিত করতে পারে এবং ঃড়ীরহ ৎবংরংঃধহঃ আগাছার উৎপাত বেড়ে যেতে পারে। ইঃ সয়াবিন, ইঃ ভুট্টাকে ইঃ বেগুনের সঙ্গে এক করলে হবে না। ইঃ সয়াবিন, ইঃ ভুট্টায় কেবল ফলন বাড়ানোর জন্য ইঃ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এতে কোনো বিষ নেই। অপরপক্ষে ইঃ বেগুনে যে জিন ব্যবহৃত হয়েছে, তা একটি বিষাক্ত কীটনাশক।
‘গ্রিন পিস’-এ নিযুক্ত ফরাসি বিজ্ঞানি ড. গিলেস এরিক সেরালিনির মতে ইঃ বেগুন তৈরিতে, আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানি একটি সেকেলে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। ইঃ বেগুন তৈরিতে প্রযুক্তিগত অস্বচ্ছতা, সীমাবদ্ধতা এবং নেতিবাচক ফলাফল ইতোমধ্যে বৈজ্ঞানিক মহলে প্রমাণিত হয়েছে। আর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট যদি একই প্রযুক্তি ব্যবহারে ইঃ বেগুন তৈরি করে থাকে, তবে তা কতটুকু নিরাপদ সেটাই ভাবনার বিষয়। যে কোনো ধরনের জিনগত পরিবর্তন জিনের ক্রমাগত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, নীরব করে দেয় অথবা পরিবর্তিত রূপ দিতে পারে।
এই ইঃ বেগুন এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন বহন করে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক উদ্বেগজনক। কারণ, এটি জিন ট্রান্সফারের জন্য দায়ী। ধষ জিন ট্রান্সফারের জন্য স্বল্পমেয়াদি গবেষণা যথেষ্ট নয়। কারণ, কমপক্ষে ৮-১০ বছরের কমে প্রাণিদেহে জিন ট্রান্সফারের প্রভাব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে গধযুপড় বিভিন্ন প্রাণিদেহে মাত্র ৯০ দিনের গবেষণা চালিয়েছে। ড. সেরালিনি আরো বলেন, প্রতি কিলোগ্রাম ইঃ বেগুন ১৬-১৭ মিলিগ্রাম ইঃ কীটনাশক বিষ ধারণ করে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, গধযুপড় যে অল্পকিছু বেগুনে পরীক্ষা করেছে, তা দিয়ে পুরো বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি পরিমাপ করা যাবে না। ইঃ বেগুনে প্রতি ১০০ গ্রামে ১৫% কিলোক্যালোরি কম থাকে এবং তাতে ভিন্ন ধরনের এলকালয়েড পাওয়া যায়। স্বল্পমেয়াদে হাঁস, মুরগি, গবাদিপশু, মাছ, খরগোশ এবং ইঁদুরের ওপর ইঃ বেগুনের প্রভাব পরীক্ষা করা হয়। সবক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নেতিকবাচক ফলাফল প্রমাণিত হয়েছে।
এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন সমৃদ্ধ ইঃ বেগুন বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা উচিত হবে না। কারণ, বিভিন্ন আধুনিক বায়োটেকনোলজি কোম্পানি এরকম মার্কার জিন ছাড়া নানা এগ ফসল বাজারজাত করছে। আরো মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ বিশ্বে অনেক দেশে বেগুন রপ্তানি করে। ফলে ইঃ বেগুন চাষাবাদ শুরু হলে সবজি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যথাযথ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং লেবেলিংয়ের অভাবে এগ ফসলের প্রতি বিরূপ দেশগুলোতে সাধারণ খাদ্য রপ্তানি কমে যেতে পারে। টঝঅ তে একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এগ ফসলে কীটনাশক ব্যবহার প্রথম তিন বছর কম হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে ৪.১%। যা মানবদেহের প্রায় ৩৩টি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী।
ইঅজও’র মহাপরিচালক বলেছেন, কৃষককে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে এই বীজ কিনতে হবে না। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এর মাধ্যমে সারাদেশের কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হবে। মনে রাখতে হবে, ইঅউঈ দেশের মোট বীজ চাহিদার মাত্র ৫ ভাগের বেশি বীজ সরবরাহ করতে সক্ষম নয়। ঐতিহ্যবাহী এই গবেষণা ইন্সটিটিউটটি বাণিজ্যিকভাবে বেগুন চাষে কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে নিজেরা কেন পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই আবিষ্কারে মনোযোগী না হয়ে বহুজাতিক কোম্পানির ইঃ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে?
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ইঃ বেগুন বিরোধীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলেন, ইঃ চাষাবাদের শুরুতেও একটি গোষ্ঠী ঐুনৎরফ-এর বিরোধিতা করেছিল। মাননীয় মন্ত্রী, আমাদের অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। উউঞ কীটনাশক শুরুতে খুবই কার্যকর থাকলেও বর্তমানে এটি পরিবেশের প্রধান দূষক, যার ক্ষতিকর প্রভাবে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন এবং জাতিসংঘ উউঞ কীটনাশককে নিষিদ্ধ করেছে। কৃষি বাস্তুসংস্থানে ইঃ বেগুন এবং অন্যান্য ঐুনৎরফ ফসলের প্রভাব একই রকম হবে- এমনটা ভাবা সমীচীন হবে না।
আধুনিক কৃষি ও গবেষণায় উন্নত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও ফিলিপাইন সরকার জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অধিকতর স্বতন্ত্র গবেষণার ফলাফল ছাড়া ইঃ বেগুন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্টও এ সংক্রান্ত একটি রায় প্রদান করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্ব পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ সরকার যেখানে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকদের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং জৈবিক দমন পদ্ধতি ব্যবহারসংক্রান্ত গবেষণায় বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করছে, সেখানে বিষাক্ত ইঃ বেগুন প্রযুক্তি কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের আহ্বানে অগ্রসরমান ঙৎমধহরপ ভধৎসরহম-এর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে। ইঃ বেগুনের অনুমোদন অন্যান্য ফসলে ইঃ প্রযুক্তিকে বেগবান করবে।
স্বতন্ত্র গবেষণার ফলাফল জনসমক্ষে উপস্থাপন না করে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বিষাক্ত ইঃ বেগুনে বিমোহিত হলে দীর্ঘমেয়াদি কৃষিতে শুভবার্তা বয়ে আনবে না। জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য বাংলাদেশের উর্বর ভূমি বহুজাতিক কোম্পানির বিষাক্ত ইঃ বেগুনের চাষক্ষেত্র না হোক। আগামীর কৃষিতে প্রযুক্তি হোক পরিবেশবান্ধব এবং মানবকল্যাণকর।
লেখক : প্রভাষক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়