কৃষিবিদ মোসলেহ উদ্দিনঃ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতি ইঞ্চি জমির ব্যবহার করতে সম্ভাবনাময় ফসল কাসাবা হতে পারে দেশের অন্যতম খাদ্য। দেখতে শিমুল গাছের মত, এই কাসাবার গাছই দূর করতে পারে দারিদ্র্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান খাদ্য এবং উৎপাদনের দিক থেকে ধান, গম, ভুট্টা ও গোলআলুর পরই কাসাবা স্থান করে নিয়েছে। উচ্চ শর্করা সমৃদ্ধ কাসাবা হচ্ছে কন্দ জাতীয় ফসল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে এর চাষাবাদ হয়ে আসছে। এ পর্যš- কাসাবার দুটি জাতের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা ফিলিপাইন থেকে আসছে। দেশের ক্রমবর্দ্ধমান খাদ্য ঘাটতি ও মঙ্গা মোকাবেলায় কাসাবা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর চাষের জন্য কোন ফসলি জমির প্রয়োজন হয় না। দেশে যে পরিমাণ অনাবাদি জমি আছে তাতেই চাষ করা যায় কাসাবা। কাসাবা চাষে উৎপাদন খরচ কম ও ফলন বেশি হয়। অল্প পরিশ্রমে অধিক ফসল পাওয়া যায় তাই কাসাবা একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ফসল আমাদের দেশে। তবে পরিবেশ ও ভবিষ্যতের কথা চিš-া করে যে কোন কৃষি কাজের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুষম সার ব্যবহার এবং জৈব প্রযুক্তির কৃষির উপর নির্ভরশীল হওয়া।
কাসাবা নিয়ে ইতোপূর্বে অনেক গবেষণার কারণে কাসাবার গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। এখন বরিশালের গৌরনদীতে সল্পপরিসরে এর চাষ শুরু হয়েছে। মোটা শেকড়ের মত মূলই হচ্ছে কাসাবা। যেটি কাঁচাও খাওয়ার যোগ্য। ফলন শুরু হওয়ার পর সারা বছরই মাটি খুঁড়ে কাসাবা সংগ্রহ করা যায়। একটি গাছ কমপক্ষে ৩ বছর ফলন দেয়, আবার গাছের পুষ্ট ডাল থেকে বীজ তৈরি করে খুব অল্প দিনেই গড়ে তোলা সম্ভব কাসাবার বাগান।
কাসাবায় রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টিগুণ। উচ্চ ক্যলোরিযুক্ত কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ ফসল এই কাসাবা। কাসাবা থেকে উন্নতমানের সাদা আটা পাওয়া যায় যা দিয়ে রুটি, বিস্কুট, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা যায়। এছাড়া শাগু, বিয়ার, পোলট্রিফিড, বস্ত্র ও কাগজ তৈরির শিল্পে প্রচুর কাসাবা ব্যবহার হয়।
কাসাবায় সধারণত যে সব রোগ বা পোকামাকড় আক্রাš- করে তার মধ্যে হোয়াইড গ্রাব, নেমাটোড, উঁই পোকা এবং ইঁদুর উলে¬খযোগ্য। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে ওষুধ ব্যবহার করলে এ সব রোগ ও পোকা দমন করা যায় সহজে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, জৈব প্রযুক্তিতে কাসাবা চাষ করলে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। কাসাবা যদিও খরা সহনশীল তারপরও খরা মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে পানি সেচ দিতে পারলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
কাসাবা সাধারণত বর্ষা মৌসুমে রোপণ করতে হয়। তবে সেচ ব্যবস্থার আওতায় এনে বছরের যে কোন সময় রোপণ করা যায়। কাসাবার বংশবি¯-ার সাধারণত স্টেম কাটিংয়ের মাধ্যমে করা হয় ৮ থেকে ১২ মাস বয়সের মধ্যে। এমন কাসাবা নির্বাচন করতে হবে যার রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত কাণ্ড চারা তৈরির জন্য আদর্শ। কাসাবা চাষের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে স্বল্পমেয়াদি ফসলও চাষ করা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যফসলের একটি হচ্ছে এই কাসাবা। খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য এর আবাদের উপযোগিতা ধরা হলেও মূলত যেকোন মাটিতেই এর আবাদ সম্ভব। কম খরচে ও সহজে দরিদ্র কৃষকরা কাসাবা উৎপাদন করতে পারে বিধায় অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে কাসাবার চাষ হচ্ছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের প্রধান খাদ্য এই কাসাবা। কাসাবা গাছ সাধারণত ৫ থেকে ৮ ফুট পর্যš- লম্বা হয়। কাসাবার মূল মূলত খাদ্য উপাদান হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হলেও এর পাতা, কাণ্ড সবই খাদ্য উপযোগী। বিশেষজ্ঞরা কাসাবাকে একটি সুষম খাবার হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। কাসাবা গাছের পাতার প্রোটিন এবং ডিমের প্রোটিনের মান সমান।
আমাদের দেশে কাসাবা উৎপাদনে যে সম্ভাবনা রয়েছে তা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে সে সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আর তারই কারণে উৎপাদনে দেখা দিচ্ছে মন্থরগতি। লাভজনক বিকল্পখাদ্য কাসাবা সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের বুঝাতে পারলে কৃষকদের মাঝে আগ্রহের সৃষ্টি হবে। কাসাবা চাষ সমগ্র বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে স¤প্রসারণ করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারবে।
পরিকল্পিত কাসাবা চাষে কৃষক পরিবারে অতিরিক্ত আয় ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া কাসাবা চাষের উপযোগী। কৃষি ও শিল্পভিত্তিক এই কাসাবা উৎপাদনের মাধ্যমে মঙ্গা কবলিত জনপদের হতদরিদ্র জনগণের বাড়তি আয় তথা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে এ পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে খুব দ্রুত এই কাসাবা আবাদ দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসেবে কাসাবা জনপ্রিয় করা হলে আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে এটি হতে পারে একটি মাইলফলক।
কৃপ্র/ এম ইসলাম