এস এম মুকুল: কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিলে বিদেশে শুঁটকি মাছ রপ্তানি করে বছরে ১০০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আমাদের দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, বৃটেন, আমেরিকা, চীন, হংকং, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ ডিহাইড্রেশন সিফুডস রপ্তানিকারক সমিতি সূত্রে, বর্তমানে প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়।
মৎস্য উৎপাদন বাড়ায় অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে চতুর্থ এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে পঞ্চম স্থান লাভ করেছে বাংলাদেশ। বিবিএসের সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী দেশে গড়ে মাছের বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে ৩৫ লাখ টন, বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মৎস্যসম্পদের উৎপাদন ও প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণায় ১৬ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল রুইজাতীয় মাছের নতুন জাত এবং দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষ ব্যবস্থাপনা ও প্রজননবিষয়ক ৪৯টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
সরকার মাছ রপ্তানি করে বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। উদ্যোক্তাদের অভিমত, কাঁচা ফুল রপ্তানি করে ৫০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বাংলার আপেল নামে পরিচিত স্বরূপকাঠির পেয়ারা দ্বারা উন্নতমানের জেলি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিশ্বের কয়েকটি দেশ পর্তুগাল, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, ভারত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে রপ্তানি হচ্ছে। জুম চাষ প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং লাভ কম হওয়ায় পাহাড়িরা কৃষি গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবন করেছে মিশ্র ফল চাষাবাদ পদ্ধতি। পাহাড়ে উৎপাদিত প্রচলিত ফল আনারস, কাঁঠাল, কলা, পেঁপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কমলা ও মাল্টা।
কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, দেশে প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর কাঁঠাল আবাদ হয়, তাতে উৎপাদন ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন এবং হেক্টরপ্রতি ফলন ১০ মেট্রিক টন’। গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরে গরু, মহিষ, ছাগল পালন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোরবানিসহ সারা দেশে এখন গরুর মাংসের চাহিদা পূরণে দেশীয় গরু পালনে স্বনির্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে কুঁচিয়া মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চীন, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের ১৫টি দেশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন এবং কৃষকদের প্রচেষ্টায় আলু চাষের সফলতা এসেছে। গত এক যুগে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা ৬১টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। পোল্ট্রি শিল্পটি বড় হচ্ছে নীরবে নিভৃতেই। দেশে বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি।
ডিম ও মুরগির মাংস রপ্তানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। দেশের একমাত্র কুমির খামার থেকে কুমির রপ্তানি করে বছরে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। চার দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট সবজি উৎপাদন হয় ২২ লাখ টন। দেশে বর্তমানে প্রায় আট লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে।
এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাক-সবজি রপ্তানি করে ৬০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ থাকলেও ওষুধশিল্পে বর্তমানে ১০০ ধরনের ওষুধ উদ্ভিদ থেকে দেড় শতাধিক ওষুধ উৎপাদন হয়। কৃষিজ উৎপাদনে সফলতার এমন হাজারো তথ্য উপাত্ত বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে নতুন আশাবাদ সৃষ্টি করছে।
লেখক : কৃষি ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক