ড. মো. খোরশেদ আলম: উপমহাদেশে প্রায় ৫০০ বছর থেকে তুলসীগাছের উপস্থিতি জানা যায়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্বাস ও ঐতিহ্যগত কারণে এই গাছের কদর লক্ষণীয়। তুলসী শব্দটি সংস্কৃত ঞধষধংর শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘অতুলনীয়’ এবং ইংরেজিতে একে ইধংরষ বলা হয় যা গ্রিক ইধংরষবঁং শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ জড়ুধষ। ফলে একে ইংরেজিতে বলা হয় করহম ড়ভ যবৎনং।
পর্তুগিজ সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে প্রিয়জনকে কবিতাসহ একটি তুলসীর পট উৎকৃষ্ট উপহার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেক্সিকোতে ব্যবসায়ীরা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে একটি তুলসীর চারা দোকানের দরজায় বা জানালায় রেখে দেয়। হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তুলসীকে অতীব পবিত্র ও পূজনীয় হিসেবে সম্মান করে এবং ইন্ডিয়ায় একে ছঁববহ ড়ভ যবৎনং বলা হয়। এ ছাড়া গ্রিস, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, মেসেডোনিয়া ও রোমানিয়ার গির্জায় তুলসীকে ধর্মীয়ভাবে সম্মান প্রদর্শন করে বেদীগুলোর মধ্যে রাখা হয়। ইউরোপে তুলসীকে মৃতের হাতে এবং হিন্দু সম্প্রদায় মৃতের মুখে রাখে যাতে তারা নিরাপদে সৃষ্টিকর্তার নিকট ফিরে যেতে পারে। প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিক বিশ্বাস মোতাবেক মৃত ব্যক্তির জন্য তুলসী বেহেশতের দরজা খুলে দেয়।
খাদ্যে তুলসীর ব্যবহার : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, তাইওয়ান এবং ইটালিতে এটি রান্নায় সুগন্ধিযুক্ত উপকরণ হিসেবে জনপ্রিয়। প্রজাতিভেদে এটি তীব্র ঝাঁঝালো, মিষ্টি ঘ্রাণযুক্ত অথবা লেবুর ঘ্রাণযুক্ত হতে পারে। যেমন বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে ইটালিয়ান মিষ্টি তুলসী (ংবিবঃ নধংরষ) থাইল্যান্ডের লেমন তুলসী (ষবসড়হ নধংরষ) এবং এশিয়ান তুলসী ক্যামিকেল উপকরণের কারণে ঘ্রাণ ও স্বাদে ভিন্ন।
সুগন্ধি হিসেবে রান্নার শেষ পর্যায়ে তুলসী ব্যবহার করা হয় যাতে ঘ্রাণ সৃষ্টিকারী উদ্বায়ী রাসায়নিক পদার্থ নষ্ট না হয়। ইটালিয়ান ঙরষ ধহফ ঐবৎন ংধঁপব জাতীয় চবংঃড় নামক খাবারে প্রধান উপকরণ হিসেবে তুলসী ব্যবহার করা হয়। তাইওয়ান ও চীনে প্রকারভেদে স্যুপ ও অন্যান্য খাবারে তাজা অথবা শুকনা তুলসী পাতার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। থাইল্যান্ডে কিছু কিছু ক্রিম, দুধ ও চকোলেটের স্বাদে ভিন্নতা সৃষ্টির জন্য তুলসী ব্যবহার করা হয়। ভিয়েতনামে থাই তুলসী নুডুলস স্যুপে ব্যবহার করে এর আকর্ষণ বৃদ্ধি করা হয়। তুলসীর বীজ পানিতে ভেজালে যে আঠালো পদার্থ তৈরি হয় তা ফালুদা অথবা শরবতে ব্যবহার করে এর স্বাদ বৃদ্ধি করা যায়।
তুলসীর ঔষধি ব্যবহার : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তুলসী আর্য়ুবের্দীয় ওষুধ হিসেবে সুপরিচিত এবং এর শুকনো পাতা মিশিয়ে পোকা-মাকড় থেকে শস্যকণা সংরক্ষণ করা হয়। প্রকারভেদে বিভিন্ন অ্যাসেনশিয়াল অয়েলের পরিমাণ ও গুণগত পার্থক্যের জন্য তুলসীপাতা বিভিন্ন ঘ্রাণযুক্ত হয়ে থাকে। এলাচিজাতীয় মসলায় বিদ্যমান ইউজিনল (বঁমরহড়ষ) নামক ক্যামিকেলের উপস্থিতির কারণে মিষ্টি তুলসী তীব্র ঘ্রাণযুক্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া সাইট্রালজাতীয় (পরঃৎধষ) ক্যামিকেলের কারণে লেমন তুলসীতে কিছুটা লেবুর ঘ্রাণ পাওয়া যায় বিধায় ইন্দোনেশিয়ায় সালাদ জাতীয় খাবারের সঙ্গে ব্যবহারে খাবারকে সুস্বাদু করে তোলা হয়। আফ্রিকান নীল তুলসীতে ক্যাম্ফর (পধসঢ়যড়ৎ) নামক ক্যামিকেলের কারণে এটির ঘ্রাণ এশিয়ান তুলসী থেকে ভিন্নতর হয়।
তুলসীপাতা মধু ও আদাসহ ইনফ্লুয়েঞ্জা, কফ ও ঠা-াজাতীয় জ্বরে ফলপ্রসূ ও প্রাচীনকাল থেকে জনপ্রিয়। তাৎক্ষণিক জ্বরে এলাচি ও তুলসীর সিদ্ধপানি গ্রহণে তাপমাত্রা কমে জ্বর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তুলসী গ্রহণে শ্বাসনালির মিউকাস দূর হয়ে সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া যায় বিধায় এটি অ্যাজমা নিরাময়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে । তুলসী পাকস্থলির মিউকাস সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করে এসপিরিন বা পাকস্থলির ক্ষত সৃষ্টিকারী ওষুধের প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষত থেকে খাদ্যনালিকে সুরক্ষা করে। তুলসীতে বিদ্যমান এসিটিক এসিড ধীরে ধীরে কিডনির পাথরকে গলিয়ে ফেলে এবং শরীরে কিডনির পাথর সৃষ্টিকারী ইউরিক এসিড কমিয়ে দেয়। করটিকোস্টেরনের (পড়ৎঃরপড়ংঃবৎড়হব) মাত্রা কমিয়ে এটি ক্লান্তি দূর করে। তুলসীতে বিদ্যমান অ্যাসেনশিয়াল ওয়েলের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল গুণাবলির জন্য এক্জিমাজাতীয় চর্মরোগে তুলসীরপাতা পিষিয়ে চামড়ায় ব্যবহার করা হয়। মুখের অভ্যন্তরীণ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে বিধায় একে টুথপেস্ট ও মুখের গন্ধ নিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
তুলসী চা অনন্য : অন্যান্য চা থেকে তুলসী চায়ের একটি ভিন্ন গুণ লক্ষ্য করা যায় তা হলো এটি ক্যফেইন (পধভভবরহব) মুক্ত। তুলসী গ্রহণে এটি প্যানক্রিয়াসের (ঢ়ধহপৎবধং) কার্যকারিতা বাড়িয়ে ইনসুলিন তৈরি করে রক্তের শর্করা কমিয়ে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করে। এ ছাড়া তে বিদ্যমান ইউজিনলজাতীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে ক্লান্তি দূর করে এবং আমাদের হৃৎপি-কে সুরক্ষায় সহযোগিতা করে। পর্যাপ্ত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জন্য একে ধহঃর ধমবরহম যবৎনং বলা হয় যার ফলে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ফ্রি-রেডিকালগুলো প্রশমিত হয়ে থাকে ।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরিচালক, পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাভার, ঢাকা।