কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ শিল্পায়ন ও অন্যান্য কর্মসংস্থানের কারণে দিন দিন কমছে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা। আর বাড়ছে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার । চলছে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা। তবে সে কাজটিতে পিছিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগ। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফরি) ‘চেঞ্জিং সিনারিও অব বাংলাদেশ এগ্রিকালচার’ শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ও সংস্থাটির নিজস্ব তথ্য বিশ্লেষণ করে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষক পাওয়ার টিলারের মাধ্যমে জমি প্রস্তুত করেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বিভাগে এ হার মাত্র ৪৮ দশমিক ২ ও বরিশালে ৬২ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে ১৭ শতাংশ কৃষক ট্রাক্টর ব্যবহারের মাধ্যমে জমি প্রস্তুত করলেও ঢাকা বিভাগের মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কৃষক ট্রাক্টর ব্যবহার করেন। এ হার সিলেট বিভাগে ৯ দশমিক ৮ ও বরিশালে ১৩ শতাংশ। পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর— উভয় যন্ত্র ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে বরিশাল ও সিলেট বিভাগ।
কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার যেখানে কম, সেখানে জমি প্রস্তুতে পশু-প্রাণীর ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল কৃষক। সারা দেশে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষক জমি প্রস্তুতে প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল হলেও এ হার বরিশালে ১৮ ও সিলেটে ২০ শতাংশ। মূলত কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারি সুবিধা কিংবা বেসরকারি খাতের বিপণন সুবিধা না পৌঁছানোর কারণেই পিছিয়ে রয়েছে এসব অঞ্চল। এছাড়া যান্ত্রিক উপায়ে জমি প্রস্তুতে এসব অঞ্চলে কৃষকের সামর্থ্য ও অনাগ্রহ কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষিতে শ্রমিক সংকট মোকাবেলা এবং উৎপাদন বাড়াতে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে বিশেষ ঋণ প্রদানসহ নগদ প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষককে যন্ত্র ক্রয়ে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে যে ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি সহায়তা দেয়া হচ্ছে, এটি আরো বেশি বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বড় ও দামি মেশিন ক্রয়ে একসঙ্গে বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব যন্ত্র দলগতভাবে কেনার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ট্রাক্টর ব্যবহার করে ধান আবাদে ৬৯ শতাংশ ও গম আবাদে ৮৪ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হয়। চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরাও।
কয়েক দশক আগেও গ্রামাঞ্চলে যৌথ পরিবার ছিল বেশি। এসব পরিবারে বড় বড় গোয়ালঘরে বাঁধা থাকত হালের বলদ। এখন পরিবার ছোট। অধিকাংশ বাড়িতে গোয়ালঘরের অস্তিত্ব নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক জোড়া বলদের বাজারদর ৬০-৮০ হাজার টাকা। বলদ পুষতেও খরচ আছে। পাশাপাশি শক্ত কাঠের লাঙল তৈরি করতে ১০-১২ হাজার টাকার দরকার হয়। লাঙল দিয়ে চাষ করতে সময়ও অনেক বেশি লাগে। অন্যদিকে বড় ট্রাক্টর অনায়াসে একদিনে ২০-২৫ বিঘা জমি তৈরি করতে সক্ষম, যা কৃষকের সময় ও খরচ বাঁচায়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন চারটি সংস্থা এবং কৃষি অধিদপ্তরের সমন্বয়ে জাতীয় কৃষিপ্রযুক্তি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার কৃষককে সরাসরি প্রযুক্তি সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে একটি তুলনামূলক গবেষণা করা হয়েছে। সে গবেষণার তথ্যে দেখা গেছে, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে নির্দিষ্ট এলাকায় ফসলের ফলন বাড়ে কমপক্ষে ১২ থেকে ৫৪ শতাংশ। এক্ষেত্রে আউশে ২৪, আমনে ২৮, বোরোয় ৯, গমে ১৯, ভুট্টায় ১২, আলুতে ১৬, টমেটোয় ১৯, বাঁধাকপিতে ৫৪, মসুরে ৫৩ ও সরিষায় ২৩ শতাংশ উৎপাদন বাড়ে। এছাড়া শ্রমিক সংকট মোকাবেলা ও সময় সাশ্রয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে এসব কৃষিপ্রযুক্তি।
দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার নিয়ে যৌথভাবে একটি জরিপ চালিয়েছে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগ। এ যৌথ জরিপের তথ্যানুসারে, দেশে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার। এর মধ্যে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের বাজার প্রায় হাজার কোটি টাকার। দেশে বর্তমানে ৫৯ হাজারের বেশি ট্রাক্টর চালু রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরেই আমদানি করা হয়েছে ৫ হাজার ৫০০টি। বর্তমানে ট্রাক্টরের বাজার ছাড়িয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া দেশে এখন প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি পাওয়ার টিলার ব্যবহার করা হচ্ছে। পাওয়ার টিলারের বাজার ছাড়িয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা।
কৃপ্র/এম ইসলাম