এস এম মুকুলঃ ফুল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মননশীলতার প্রতীক। উপহার, সংবর্ধনা, গায়ে হলুদ, বিয়ে, পূজা-পার্বণ এমনকি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতায় ফুল এখন অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আধুনিক সমাজে ফুলের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে শুধু শৌখিনতা নয়, ফুল এখন বিরাট এক অর্থকরী ফসল। সময়ের চাহিদার আলোকে দেশের অর্থনীতিতে ফুলের অবদান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফুলের বাণিজ্যিক প্রসার খুব বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকের আগে দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর।
বর্তমানে দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। মাত্র দুই দশকের পথচলায় ফুল বাণিজ্য অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। জানা গেছে ১৯৮২-৮৩ অর্থবছর থেকে দেশে ফুল অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এরপর থেকে ক্রমেই প্রসার হচ্ছে ফুলের বাণিজ্য। এই খাতে বাড়ছে কর্মসংস্থান। দেশের গ-ি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ফুল। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
বিশ্বে ফুল বাণিজ্য
বিশ্বে ফুল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ফুল বিক্রয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ফ্লোরাহল্যান্ড। আন্তর্জাতিক নিলামের মাধ্যমে প্রতিদিন সেখানে বেচাকেনা হয় ২ কোটি ১০ লাখ ফুল। বিশ্বজুড়ে বিক্রীত ফুলের প্রায় ৫২ শতাংশ রপ্তানি হয় এ বাজার থেকে। ভালোবাসা দিবসের আগে সপ্তাহজুড়ে সেখানে হাট বসে কোটি কোটি গোলাপ, টিউলিপ ও অন্যান্য ফুলের।
বাণিজ্যের বাইরে বাগান থেকে সংগ্রহ করা ফুলের স্থায়িত্ব পরীক্ষা, পৃথিবীব্যাপী ফুল চাষের হিসাব-নিকাশও করা হয় এখানে। উত্তর আমেরিকায় ফুলের সবচেয়ে বড় নিলাম অনুষ্ঠিত হয় কানাডার বারনাবির সাউথওয়েস্ট গার্ডেন সাপ্লিয়াসে। প্রতি সোম, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় সমাগম ঘটে ফুলের খুচরা বিক্রেতার। বছরে ভ্যালেন্টাইনস ডে ও মাদারস ডেতেই কানাডায় কাটতি হয় ১৫ কোটি ফুলের।
১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুর ফুলের বাজারে বসে লাল গোলাপের মেলা। প্রায় ৫০ লাখ গোলাপ আসে অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও দিলি্ল থেকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ের দাওনান ফ্লাওয়ার মার্কেটের ব্যস্ততা থাকে মধ্যরাত থেকে ভোর চারটে অবধি। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ ফুল চীন ও বহির্বিশ্বের বাজারে সরবরাহ করা হয়। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, নববর্ষ এসব দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশজুড়েও শত কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়। এসব উপলক্ষকে সামনে রেখে ফুলের রাজধানী যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে ফুল বিক্রির ধুম পড়ে যায়।
ফুলের রাজধানী গদখালী
যশোর থেকে বেনাপোলের দিকে যেতে ছোট জনপদ গদখালী। ঝিকরগাছা উপজেলা সদর থেকে পশ্চিমে অবস্থিত এই জনপদটির মাঠে মাঠে যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। এখানকার প্রায় ৪০টি গ্রামে উৎপাদিত হয় রজনীগন্ধা, গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাস ও জারবেরাসহ বিভিন্ন ফুল। অন্যান্য অর্থকরী ফসলের পাশাপাশি ফুল চাষ করেও যে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন গদখালীর মানুষ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গদখালীতে ফুলের চাষ শুরু হয় ফুলচাষি শেরআলীর হাত ধরে। ১৯৮৩ সালে তিনি ভারত থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বীজ এনে গদখালীতে চাষ শুরু করেন, পরে তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের অন্য কৃষকগোষ্ঠী শুরু করেন ফুল চাষের বিপ্লব। শেরআলী এরপর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে অনেক ফুলের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করেন। এখন ঝিকরগাছার দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ। এখানে বিঘাপ্রতি মৌসুমে কৃষকরা আয় করেন প্রায় ৪ লাখ টাকা।
কালের পরিক্রমায় পথ দেখানো সেই গদখালীকে এখন ফুলের রাজধানী বলা হয়। ফুলচাষে শেরআলী সরদারের ব্যাপক অবদানের জন্য তাকে স্থানীয়ভাবে ফুলচাষের জনকও বলা হয়। সারাদেশে যে ফুল উৎপন্ন হয় তার অন্তত ৭০ ভাগ হয় এই গদখালীতেই। আশির দশকে যে গদখালীতে এক বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হয়েছিল সেখানে এখন প্রায় ১৮০০ বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। তবে ঝিকরগাছার গদখালী এলাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী শার্শা উপজেলাতেও ফুল চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফুলচাষিরা বলছেন বর্তমানে ওই এলাকায় প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। এসব জমি থেকে ভরা মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ২ লাখ রজনীগন্ধার স্টিক, ৪ লাখ গাঁদা ফুল, ৩০ হাজার গোলাপ, ৫০ হাজার গ্লাডিওলাস ফুলের স্টিক উৎপন্ন হয়। অন্যান্য ধরনের ফুল উৎপন্ন হয় প্রায় ৩০ হাজার।
রপ্তানি বাজারে সম্ভাবনার হাতছানি
বিশ্ব ফুলের বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে ফুল। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল ও বাহারি লতাপাতার গাছ উৎপাদন স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানির তালিকায় একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আশা জাগিয়েছে। জানা যায়, ১৯৯১-৯২ বছর থেকে ফুল রপ্তানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র মতে, ২০০৫ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকার। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এদেশ থেকে ফুল রপ্তানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকার, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার এবং ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ফুল রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের কাঁচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালি, কানাডা, চীন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রপ্তানি করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ফুলের বাজারে বাংলাদেশের জন্য আরও বড় আকারের রপ্তানির সুযোগ অপেক্ষা করছে।
জীবিকা, চাষাবাদ ও হাট-বাজার
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ করা হচ্ছে। বছরে দেশে ৭৮৪ কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য হয়। তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ফুলের বাজার আছে ৪০০ কোটি টাকা। সারাদেশে খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। দেশের ২০টি জেলায় বিভিন্ন জাতের বিপুল পরিমাণ ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। ফুল চাষে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও মানুষ ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছে। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির তথ্যানুযায়ী, সারা ঢাকায় ফুটপাতসহ অভিজাত ফুল বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা এখন প্রায় এক হাজার। আর সারাদেশে এই সংখ্যা চার হাজারের বেশি। বাংলাদেশে ফুলচাষে অগ্রগামী যশোর ও ঝিনাইদহ। জানা যায়, দেশের মোট ফুলচাষের সিংহভাগই এ জেলা দুটি থেকে আসে। এখানকার ফুল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের ৫৪টি জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। আশার খবর হলো বর্তমানে নতুন করে মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা ও বগুড়াও ফ্লাওয়ার জোন হিসেবে গড়ে উঠছে।
আশায় আছে অন্তরায়
ফুলচাষিদের অভিযোগ প্রশিক্ষণের অভাব, মানসম্মত বীজের স্বল্পতা, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ফুল শিল্পে আশানুরূপ উন্নতি করা যাচ্ছে না। দেখা গেছে, পরিবহনব্যবস্থার অভাবের কারণে অনেক সময় ফুল পচে বড় ধরনের ক্ষতি সম্মুখীন হতে হয় চাষিদের। এসব সমস্যা সমাধান করা গেলে ফুলের উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে। আবার ফুল রপ্তানিকারদের মতে, ফুল দু’একদিন তাজা থাকে তারপর নষ্ট হয়ে যায়। এ অসুবিধা দূর করার জন্য ফ্রিজার ভ্যানের প্রয়োজন। উন্নত জাতের ফুলের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা, ফুলচাষিদের পর্যাপ্ত আধুনিক প্রশিক্ষণ সে সঙ্গে ফুলের সংরক্ষণ, পরিবহন, প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করতে হবে। তাহলেই এ খাতে রপ্তানি বহুগুণ বৃদ্ধির মাধ্যমে একদিকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলো ফুলচাষিদের ঋণ দিতে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। ফুলচাষিদের মতে, অবিলম্বে গদখালীতে একটা স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা দরকার। ফুলচাষ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এবং লাভজনক হলেও সরকারি আর্থিক সহায়তার অভাবে এগোত পারছে না ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীরা।
লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং উন্নয়ন গবেষক।
কৃপ্র/এম ইসলাম