বাংলাদেশের কৃষি প্রযুক্তি সমপ্রসারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর। এই প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ের একজন কৃষি সমপ্রসারণ কর্মকর্তা প্রায় ২০০০ কৃষক পরিবারকে কৃষি সেবা দিয়ে থাকেন। নিশ্চিত করে বলা যায়—সময়, আমাদের গ্রামগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান এবং সমপদের প্রাপ্যতা বিবেচনায় একজন কৃষি সমপ্রসারণ কর্মীর জন্য এ একটি বিশাল দায়িত্ব।
তাছাড়া কৃষির সবুজ বিপ্লবের সময়কালে সমপ্রসারণ কর্মীরা কৃষি উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও এখনকার প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন। কৃষি উত্পাদনে আজ অনেক চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে। দ্রুত শহরায়ণ, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, ক্ষয়িষ্ণু জীব-বৈচিত্র্য, ফসল উত্পাদনে পানির স্বল্পতা, জমির উর্বরতা হ্রাস, ভূমি ক্ষয়সহ হাজারো চ্যালেঞ্জ আজ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থাপনায়। এসব কিছু কৃষি সমপ্রসারণ কর্মীর দ্বারা কতটুকু সঠিকভাবে করা সম্ভব তা বুঝতে আমাদের কারোরেই খুব বেশি কষ্ট হবার কথা নয়।
বাংলাদেশের কৃষিতে অনন্তকাল থেকে মহিলারা এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছেন । কিন্তু বাড়ির অন্য কাজগুলো সামলানো ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাঁরা পুরুষ সহকর্মী কিংবা পরিবারের পুরুষ সদস্যের মতো একজন কৃষি সমপ্রসারণ কর্মীর সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত হোন অথবা নতুন প্রযুক্তির কথা জানতে পিছনে পড়ে থাকেন। অনেক কাজ করতে পারলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতার উন্নতি পুরুষ কৃষকটির মতো করে হয় না। কৃষির উন্নয়নের জন্য এ এক বিশাল অন্তরায়। বিশ্লেষণ করলে এমন অনেক অন্তরায় বিবেচনায় আনা যায়, যার সামান্য একটু উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের জ্যোতিটি আরো উজ্জ্বলতর হবে। কৃষিতে যুতসই ও প্রয়োজনীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সহজেই এসবের অনেকাংশের সমাধান দিতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তা যথার্থ। দেশের কৃষকরা এ থেকে লাভবান হচ্ছেন। প্রশংসনীয় যে, বাংলাদেশের কৃষিবিদরাই উদ্ভাবন, পরিকল্পনা ও ডিজাইন করেছেন কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন নামে ই-কৃষি সমপ্রসারণের উপযোজন বা অ্যাপ্লিকেশান।
ই-কৃষি সমপ্রসারণ সেবার মাধ্যমে কৃষক এবং কৃষির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সহজেই ফসলের রোগবালাই ও তার ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে জানতে পারবেন। কিছু কিছু কৃষি বিষয়ক সিদ্ধান্তও কৃষকরা নিতে পারবেন ই-সমপ্রসারণের সেবা ব্যবহার করে। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের আরো বেশি সেবা দেওয়া সম্ভব। ভার্চুয়াল কৃষি প্রশিক্ষণ, ভিডিও কনফারেন্স, সরাসরি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কৃষকের যোগাযোগ, সিদ্ধান্ত সহায়ক টুলসহ অনেক কিছুই বাংলাদেশের কৃষিতে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করবে এটা জোর দিয়ে বলা যায়। অন লাইন বা ওয়েব বেসড সিদ্ধান্ত সহায়ক টুল এখন উন্নত
বিশ্বে কৃষকদের কৃষি ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম সহায়ক শক্তি। যেমন, Monitor, Soilmapp, Yield Prophet, APSim প্রভৃতির মতো অনেক সিদ্ধান্ত সহায়ক টুলের মাধ্যমে কোন অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পূর্বাভাস, কৃষি জমির গুণাগুণ, উর্বরতা, আর্দ্রতা, উত্পাদনের পূর্বাভাস, বীজ বপন থেকে ফসল কর্তনের দিন নির্ধারণ এমনকি জলবায়ুর কোন অবস্থায় কি ধরনের রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিতে পারে সে ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশের কৃষকরা এবং এর সঙ্গে জড়িত কর্মীরা ওয়াকিবহাল হতে পারেন এবং সঠিক সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নিতে পারেন।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। বিটিআরসির ২০১৬-র হিসেব মতে এখন প্রায় পৌনে ১২ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। প্রাক্টিকেল অ্যাকশন নামের একটি এনজিওর সহায়তায় ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি কল সেন্টার (১৬১২৩) পরিচালনা করে আসছে। শুরু থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এই কল সেন্টারের মাধ্যমে ৬৫৬২০ টি ফেরত কলের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি, মত্স্য ও প্রাণিসমপদ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই কল সেন্টারটিতে কৃষি, মত্স্য ও পশুপালন বিষয়ে পরামর্শ দেবার জন্য মাত্র ৫ জন কৃষি গ্রাজুয়েট কাজ করছেন।
বাংলাদেশের কৃষিতে নিয়োজিত জনসংখ্যার তুলনায় এ কলের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। কিন্তু এটিকে কৃষকদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন। আর এ জন্য এটার লোকবল বাড়াতে হবে। যাতে কৃষকরা বিশেষজ্ঞ অভিমত পেতে পারেন সে জন্যে এর সঙ্গে বিশেষজ্ঞ প্যানেল সংযুক্ত করতে হবে। কৃষকরা যাতে তাঁদের মাঠের সমস্যাটা সরাসরি কল সেন্টারে কর্মরত কৃষি বিশেষজ্ঞের কাছে তুলে ধরতে পারেন সে জন্য ভিডিও কল, ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থা সংযুক্ত করারও প্রয়োজন আছে। কৃষককে কল সেন্টারে ফোন করতে হলে এখন প্রতি কলে মিনিটে ২৫ পয়সা করে কল চার্জ দিতে হয়। কৃষকরা যাতে বিনা পয়সায় অথবা আরো কম পয়সায় কল সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে সে বিষয়টিও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। কৃষি বান্ধব বর্তমান সরকার কৃষির উন্নয়নে প্রশংসনীয় অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সরকার সঠিক পরিকল্পনা নিলে ও আরো একটু উদ্যোগী হলে কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার অল্প সময়ে অনেক বেড়ে যাবে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষির উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর তথা কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে তাঁদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে অতি দ্রুত সমপৃক্ত করা এখন অনেকটা সময়ের দাবি।
লেখক :প্রবাসী পলিসি বিজ্ঞানী
কৃপ্র/এম ইসলাম