ড. মো. আনোয়ার হোসেন: কৃষিই কৃষ্টি, কৃষিই সভ্যতা, কৃষিই আমাদের মতো দেশের উন্নয়নের একমাত্র অবলম্বন। সেই স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ জমিই তিন ফসলিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে হাওরের মতো বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি সেই মান্ধাতা আমলে পড়ে আছে। আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে লাগেনি বললেই চলে। এখনও এ অঞ্চলের জমি এক ফসলি হয়ে আছে। প্রকৃতিনির্ভর সেই কৃষিকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে পরিবর্তন করে উন্নততর কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেই লক্ষ্যে বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ নির্দেশে হাওরের কৃষি উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে হাওর ইনস্টিটিউট খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
হাওরাঞ্চলে ধানই একমাত্র ধর্তব্য প্রধান কৃষি ফসল। বছরের ছয় মাস মোটামুটি পানির নিচে থাকায় অন্য কোনো সময় কৃষি আবাদ করা কার্যত অসম্ভব। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোটামুটিভাবে পানি নেমে যাওয়ায় হাওরাঞ্চলের জমি কৃষিকাজের উপযোগী হয়। এ সময়ে ধানের বীজতলা তৈরি করে জাওলা বা চারা জন্মানো হয়। কৃষিজমি চাষ দিয়ে কাদা করে চারা রোপণের উপযোগী করা হয়। তারপর মোটামুটি মাস খানেক বয়সের জাওলা তুলে জমিতে রোপণ করা হয়। ধানের জাতের প্রকারভেদে ৯০-১২০ দিনের মধ্যে ধান কাটার উপযোগী হয়। তবে উপরে বর্ণিত পদ্ধতি তখনই সফলভাবে কাজ করে, যখন প্রকৃতি সদয় থাকে। হাওরের পানি আসা ও বের হয়ে যাওয়ার সময়ের ব্যত্যয় ঘটলেই ধান উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
আগাম বা দেরিতে বর্ষাকাল শুরু বা অতিবৃষ্টি হলে ধান উৎপাদন সময় মারাত্মকভাবে পরিবর্তিত হয়। দেরিতে বর্ষা হলে ধান উৎপাদন প্রক্রিয়া ভালোভাবে শেষ হয়, যদিও জমিতে কৃত্রিমভাবে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আগাম বর্ষণ হলে হাওরে নির্দিষ্ট সময়ের আগে পানি প্রবেশ করে এবং সব কৃষিজমি তলিয়ে যায়। ধান পাকার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় না। ফলে কৃষকের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার আগেই ধান কাটতে হয়। আধা পাকা ধান কেটে কৃষকরা ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে ধান কাটার জন্য শ্রমিক না পাওয়া, মাড়াইয়ের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও জায়গার অভাবে ধান নানাভাবে নষ্ট হয়। আবার অনেক কৃষক ধান কাটার সময়ই পান না, যখন দ্রুত পানি প্রবেশ করে ধানক্ষেত ডুবিয়ে দেয়। ফলে
ধানের উৎপাদন অনেক কম হয়ে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কোনো বছরে অতি বৃষ্টি হলে পানি হাওর থেকে চলে যেতে অনেক সময় নেয়। সে ক্ষেত্রে ধানের উৎপাদন সময় পরিবর্তিত হয়ে নাবি ফসলে রূপান্তরিত হয়। এ সময় ধানের বীজতলা তৈরি ও চারা উৎপাদনে দেরি হয়। চাষের জমিতে ধানের চারা রোপণ করতেও দেরি হয়ে যায়। ফলে ধান পরিপুষ্ট হয়ে পাকার আগেই হাওরে পানি প্রবেশ করার সময় চলে আসে। তখন কৃষকদের আধাপাকা ধান কর্তন করে দ্রুত মাড়াই করতে হয়। ধান পূর্ণ পকস্ফতা না পাওয়ায় ফলন কম হয় এবং ধানের তথা চালের গুণগত মান নিম্নমুখী হয়। এ ক্ষেত্রে চাষিরা তাদের উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়।
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা এ সমস্যার পুরোপুরি সমাধান না দিতে পারলেও অনেকাংশে সমস্যা কমিয়ে চাষিদের ক্ষতির মাত্রা কম করে দিতে পারে। পানি থাকায় বীজতলা তৈরির ক্ষেত্রে কলাগাছের ভেলা তৈরি করে ওপরে ঘাস-লতাপাতা ও কাদামাটি দিয়ে ভাসমান বেড করে ধানের চারা উৎপাদন করা যায়। ফলে ধানের চারার জন্য উৎপাদন মৌসুমের কোনো ক্ষতি হয় না। জমি তৈরির জন্য পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য কমবাইন্ড হারভেস্টার ও থ্রেসার ব্যবহারের মাধ্যমে ধান উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত করা যায়। ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা যে সমস্যার সম্মুখীন, তা অনেকাংশে লাঘব করা যায়।
কৃষি ও বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে হাওরাঞ্চলের উপযোগী ও ৯০ দিনের কম সময়ে পরিপকস্ফতা পেতে পারে সে রকম ধানের জাত উদ্ভাবন করতে পারেন। ফলে আগাম বর্ষণের ফলে সৃষ্ট সমস্যা অনেকাংশে দূর করা যেতে পারে বা ভবিষ্যতে দূরও হতে পারে। তাছাড়া হাওরের পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা কৃষকের ফসল উৎপাদনের অনেক সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে।
যেমন হাওরের পলি জমা নদী ও পানি নিষ্কাশন খাল খননের মাধ্যমে অতিরিক্ত বর্ষণের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দ্রুত দূর করা যায়। ফলে ধান উৎপাদন মৌসুমের ব্যাঘাত ঘটে না। আগাম বর্ষণের ফলে পানি যাতে মূল হাওরের বাইরের অঞ্চলের কৃষিজমিতে সহসায় প্রবেশ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ড্রেজিং করে মূল হাওরের পানি ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া মূল হাওরের পানি যাতে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারে, তার জন্য নদী খনন ও সংযোগ খাল তৈরি করা যেতে পারে। ফলে ধানি জমি দ্রুত ডুবিয়ে দেওয়া অনেকটা রক্ষা করা যেতে পারে। কৃষক ফসল ঘরে তোলার জন্য বেশি সময় পেতে পারে।
হাওরাঞ্চলে সরিষা, শিম, বরবটি, মরিচ ও বেগুন জাতীয় কৃষি আবাদ দেখা যায়। যদিও পরিমাণ কম। এ অঞ্চলে পালং শাক, লাল শাক, মুলাসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। দেখা যায়, হাওরের প্রতিটি গ্রামের আশপাশে প্রচুর জমি অনাবাদি পড়ে আছে। সেসব জমিতে হয় ঢোল কলমি, না হয় শুধু আগাছা জন্মে আছে। এসব জমি চাষের উপযোগী করে শিম, বরবটি, মরিচ, বেগুন, পালং শাক, লাল শাক, মুলা, পুঁই শাকসহ বিভিন্ন সবজি জন্মানো যেতে পারে। মাচান দিয়েও অনেক সবজি (যেমন শিম, পুঁই শাক ও লাউ) জন্মানো যেতে পারে, যা পানিতে ডুবে গেলেও উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে না। ভাসমান ভেলায় সবজি চাষ, জলাশয়ে কলমি ও হেলেঞ্চা শাকের চাষ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিশেষ পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে এ হাওরাঞ্চলের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এ ধরনের কৃষি সম্প্রসারণ হাওরাঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন তথা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষককুল লাভবান হতে পারে, যা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
হাওরাঞ্চলের গ্রামের বসতবাড়ির চারপাশে বিভিন্ন কাঠের গাছ, বাঁশ ও কলাগাছ ব্যাপক হারে রোপণ করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ প্রজেক্ট নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া হিজল, করজসহ বিভিন্ন লোকাল গাছের চারা তৈরিসহ বিতরণ ও রোপণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ গাছ শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশই রক্ষা করবে না, বসতবাড়ির ভিটামাটি হাওরের পানিতে ভেঙে ও ধুয়ে যাওয়া রোধ করবে। ঝড়ের সময় হাওরের পানিতে সৃষ্ট তাফালিং হতে গ্রাম ও বাড়িগুলোকে রক্ষা করতে এসব লাগানো গাছের সবুজ বেষ্টনী বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। তাছাড়া কাঠ, বাঁশ ও কলা বিক্রি করে বাসিন্দারা লাভবান হতে পারে।
হাওরাঞ্চলের মান্ধাতা আমলের কৃষিকে আধুনিকায়ন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কৃষি বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন, এ অঞ্চলে কাজ করা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, এনজিওসহ সবার সমন্বয়ে হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপযোগী কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সে কৃষি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন ও ফলোআপ করে সফল করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। আমি হাওরাঞ্চলের উপযোগী সে রকম এক কৃষি ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করছি।
অধ্যাপক, কৃষি ও পরিবেশ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ