কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ভোলা জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে হাঁস পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকেই। বিচ্ছিন্ন এসব দ্বীপগুলোতে প্রচুর বিলাঞ্চল ও সমতল জমি থাকায় এখানে হাঁস পালন অনেকটাই সহজ। চারদিকে নদী-খাল থাকায় প্রচুর শামুক পাওয়া যায় এখানে। যা হাঁসের প্রধান খাদ্য। এর মাধ্যমে দারিদ্র্যকে জয় করে স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে বহু পরিবার। চরগুলোতে সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যেগে গড়ে উঠেছে শত শত হাঁসের খামার।
এসব খামারে উৎপাদিত ডিম গ্রামের হাট-বাজার হয়ে চলে যায় শহুরে দোকানগুলোতে। আর সম্প্রতি চরাঞ্চলে বেকারত্ব দূর করতে হাঁস পালনে আগ্রহ বাড়ছে বেকারদের। শুধু চর চটকিমারা নয়, ভেলুমিয়া চর, ইলিশা ইউনিয়নের মাঝের চর, ভেদুরীয়ার চর গাজী, ধনীয়া, রাজাপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চরে হাঁস পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
উপজেলা সদরের ভেদুরিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন চর চটকিমারা গ্রাম। খেয়া নৌকার মাধ্যমে প্রায় ১০ মিনিটের তেতুলীয় নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এই চরে। প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এখানে হাঁস পালন করে অনেকেই বেকারত্ব দূর করেছেন। ভাগ্য বদলেছে এখানকার বহু পরিবারের। বসত ঘরের পাশে নেট (জাল) দিয়ে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। প্রতিটি খামারে ৪শ’ থেকে ১ হাজার হাঁস রয়েছে। এসব খামারে কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করছে।
হাঁসখামারী মো. আলাউদ্দিন মিয়া জানান তিনি গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাঁস পালন করে আসছেন। বসত ঘরের পাশের জমিতে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। প্রথমে ২শ’ হাঁস দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার প্রায় ৭শ’ হাঁস রয়েছে। দৈনিক প্রায় ৫শ’ ডিম হয় তার খামারে। ১শ’ ডিম ৯শ’ টাকা মূল্যহারে তার ৪ হাজার ৫শ’ টাকার ডিম বিক্রি হয় দৈনিক। অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে তার ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা লাভ হয়।
হাঁসখামারী মোসলেউদ্দিন বলেন, গত ৩ বছর যাবত তিনি হাঁস পালন করছেন। আগে কৃষি কাজ করলেও অধিক লাভের আশায় হাঁস পালন শুরু করেছেন। বর্তমানে তার ৫শ’ হাঁস রয়েছে। দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩শ’ ডিম হয় তার খামারে। ডিম বিক্রি করে তিনি স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছেন বলে জানান। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. সিরাজ গোলদার বাসস’কে বলেন, চটকিমারায় অনেক দিন থেকেই হাঁস পালন করছেন কৃষকরা। তবে সম্প্রতি বাণিজ্যিকভাবে হাঁস পালনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছ হচ্ছে। হাঁস পালনে স্বল্প খরচ হওয়ায় অনেকেই এর সাথে যুক্ত হচ্ছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করছি।
বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের বাসিন্দারা কৃষি কাজ ও মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত। আবার কেউ কেউ গবাদি পশু-পাখি পালন করে। প্রায় অর্ধশত পরিবার হাঁস পালনের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতিটি পরিবারই এখন অভাবকে জয় করেছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যায় নিয়মিত। পারিবারিকভাবে প্রায় প্রতিটি বসত ঘরে হাঁস লালন করা হলেও বাণিজ্যিকভাবে বর্তমানে হাঁস পালন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এতে করে বদলে যাচ্ছে অনগ্রসর ও পিছিয়েপড়া এই জনগোষ্ঠির জীবনমানসহ সার্বিক চিত্র।
খামারী জোছনা বেগম জানান, তার স্বামী কৃষি কাজ করেন। তার খামারে ৫শ’ হাঁস রয়েছে। তিনি ছেলেকে নিয়ে খামার পরিচালনা করেন। হাঁস পালনে তেমন পরিশ্রম হয় না জানিয়ে বলেন, সকালে এসব হাঁস তার ছেলে বিল ও নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে দলবদ্ধভাবে শামুকসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খামার খায় তারা। সন্ধ্যের আগে আবার খামারে নিয়ে আসা হয়। তারপরেও দিনে ২বার করে তাদের খাবার হিসাবে ধান দিতে হয়। দৈনিক প্রায় ১ হাজার টাকা খরচ হয় ৫শ’ হাঁসের জন্য। আর লাভ হয় প্রায় ২ হাজার টাকা।
শুধু জোছনা বেগম, আলাউদ্দিন নয়, হাঁস পালন করে ভাগ্য বদল করেছেন অনেক খামারী। এর মধ্যে আবুল কালামের (৩২) ৫শ’ হাঁস রয়েছে। রুবেলের (৩০) ৪শ’ হাঁস, ইউসুব জমাদ্দারের (৩৩) সাড়ে ৩শ’ হাঁস, জসিমউদ্দিনের (৩০) ৫শ’ হাস, আব্দুল হাইর (৩৫) ৬শ’ হাঁসসহ প্রায় অর্ধশত খামারে হাজার হাজার হাঁস রয়েছে। শুধু হাস প্রতিপালন করে জীবিকা নির্বাহ করছে এসব পরিবার। ডিমের পাশাপাশি এই শীতে হাঁস বিক্রি করেও লাভবান হয়েছেন অনেকে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: প্রদীপ কুমার কর্মকার জানান, জেলায় বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭শ’ হাঁসের খামার গোড়ে উঠেছে। একটি উন্নত জাতের হাঁস বছরে আড়াইশ’ থেকে পৌনে ৩শ’ ডিম দেয়। এসব খামারীদের সাথে উঠোন বৈঠক, সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও প্রচার পত্র বিলির মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে সব ধরনের গারিগরি সহায়তা। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে প্রাণিসম্পদ ৫শ’ খামারীকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনেছে। এছাড়া জেলায় সরকারিভাবে হ্যাচারিসহ হাঁস প্রজনন খামার স্থাপনের কাজ চলছে। এটি সম্পন্ন হলে এখান থেকেই খামারীরা হাঁসের ডিম ও উন্নত জাতের বাচ্চা সংগ্রহ করতে পারবেন। এতে সম্প্রসারণ ঘটবে হাঁস পালনের।
সুত্রঃ বাসস / কৃপ্র/এম ইসলাম