কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায়: বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের দুই লাখেরও বেশি জেলে কাঁকড়া চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন ছবি : ইন্টারনেটকাঁকড়া। একেবারেই অবহেলিত এক জলজ প্রাণী। অবহেলিত এই কাঁকড়াই খুলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার। কারণ বিদেশে এই কাঁকড়ার চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। সঠিক পরিকল্পনা নিলে এ পণ্য বদলে দিতে পারে লাখো মানুষের ভাগ্য।
কাঁকড়া রপ্তানি করে এখন প্রতিবছর গড়ে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। দিন দিন যে হারে চাহিদা বাড়ছে তাতে সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত চিংড়িকেও হার মানাতে পারে এই জলজ সম্পদ-এমনটাই মনে করছেন কাঁকড়া চাষিরা। কাঁকড়া রপ্তানি করে বছরে হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এখন প্রয়োজন শুধু সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা।
কাঁকড়া চাষের সুবিধা অনেক কারণ কাঁকড়ার দ্রুত বংশবিস্তার ঘটে। কাঁকড়া চাষে পরিশ্রম কম। অল্প উৎপাদন ব্যয়ে অধিক অর্থ আয় করা যায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলী জমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে দিন দিন কৃষকের আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ত পানিতে কাঁকড়া চাষ করে এই সংকট অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব এবং কাঁকড়া চাষ উপকূলীয় অঞ্চলে হতে পারে গরিব মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস।
বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়ার চাষ কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। অনেকে কাঁকড়ার চাষ করে তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশে দুই ধরনের কাঁকড়া পাওয়া যায়। একটি লোনাপানির আর একটি মিঠা পানির। লোনা পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ যত বেশি হয়, কাঁকড়ার উৎপাদনও তত বৃদ্ধি পায়।
দক্ষিণাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, বিস্তৃত চিংড়ি ঘের ও সুন্দরবনের গোটা বনাঞ্চলে প্রচুর লোনা পানির কাঁকড়া পাওয়া যায়। কাঁকড়ার গড় আয়ু এক থেকে দেড় বছর। চিংড়ি ঘেরের ৯০ শতাংশ কাঁকড়াই সংগ্রহ করা যায়। প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া কাঁকড়ার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আহরণ করা সম্ভব। দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ জেলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ারের তথ্য মতে, কেবল সুন্দরবন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার জেলে কাঁকড়া ধরে সংসার চালায়। কাঁকড়াচাষিরা জানান, বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এবং জুন থেকে জুলাই হচ্ছে কাঁকড়ার প্রজনন কাল। এ সময় গভীর সমুদ্রে ও সুন্দরবনের মধ্যে ডিম থেকে কাঁকড়ার জন্ম হয়। এসব পোনা পানিতে ভেসে ভেসে নদ-নদী, খাল-বিল ও মাছের ঘেরে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়।
প্রজননের সময় উপকূলীয় অঞ্চল ও সুন্দর বনের বিস্তৃত এলাকায় জলাশয় ও তীরে প্রচুর কাঁকড়ার পোনা চোখে পড়ে। খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বাগেরহাটের রামপাল ও মংলার খামারে তিন পদ্ধতিতে কাঁকড়ার চাষ হতে দেখা যায়। প্রথম পদ্ধতিতে ছোট ছোট পুকুরে রেখে কাঁকড়া মোটাতাজা করা হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বড় বড় ঘেরে চিংড়ির সঙ্গে কাঁকড়ার চাষ করা হয়। আর তৃতীয় পদ্ধতিতে উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় আটকে রেখে কাঁকড়া চাষ করা হয়। খামারে কাঁকড়ার খাবার হিসেবে ছোট মাছ, কুঁচে, শামুকের মাংস দেয়া হয়। এসব খাবার চাষিরা ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে কিনে থাকেন।
মংলা এলাকার একজন চাষি জানান, প্রায় সারা বছরই কাঁকড়ার চাষ করা হয়। রপ্তানি উপযোগী প্রতিটি কাঁকড়ার গড় ওজন হয় ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। এসব কাঁকড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। কোনো কোনো সময় এক কেজি কাঁকড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়ও বিক্রি করা হয়। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েক হাজার কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে। শুধু সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় প্রায় ৯ হাজার কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার রয়েছে। পাইকগাছার খামারি মজিবর জানান, মাত্র এক বিঘার ঘেরে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করা সম্ভব। দুই থেকে আড়াই মাস বয়সের কাঁকড়া ঘেরে ছাড়ার পর ২০ থেকে ২৫ দিনেই তা বিক্রির উপযোগী হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে মাড ক্রাব বা শীলা কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি। তাই কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চিংড়ি চাষে ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থাকলেও কাঁকড়া চাষে এ ঝুঁকি নেই। কক্সবাজারের কাঁকড়া চাষিরা নিয়মিত প্রায় ২০টি দেশে কাঁকড়া রপ্তানি করছে।
বিদেশে বাংলাদেশের কাঁকড়ার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে চীন, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। প্রতিবছরই বাড়ছে কাঁকড়া রপ্তানির পরিমাণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। দেশে মোট ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১১ প্রজাতির সামুদ্রিক কাঁকড়া রয়েছে। শীলা এবং সাঁতারো কাঁকড়া বিদেশে বেশি রপ্তানি হয়। জীবন্ত ও হিমায়িত দুভাবেই কাঁকড়া রপ্তানি হয়। রপ্তানিকৃত কাঁকড়ার মধ্যে ৯২ শতাংশই যায় চীনে।
১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মাত্র ২ হাজার ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ২ হাজার মেট্রিক টন কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি হলেও ২০০৫-০৬ অর্থবছরে শুধু পাইকগাছা থেকে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়, যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ সালে কাঁকড়া রপ্তানি হয় ২ হাজার ৯৭৩ মেট্রিক টন। ২০১১-১২ সালে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪১৬ মেট্রিক টনে এবং ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে এই রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টনে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭২ লাখ ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কাঁকড়া রপ্তানি হয় ২ কোটি ২৯ লাখ ডলারের এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাঁকড়া রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। গত বছর সারা দক্ষিণাঞ্চল থেকে ৭০ কোটি টাকার কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছে বলে জানা যায়।
কাঁকড়া চাষে সম্পৃক্ত হয়ে অনেক তরুণ যুবক নতুন আয়ের পথ খুঁজে পাচ্ছে। এতে বেকারত্ব কমছে। বাড়ছে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন। আমাদের দেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং ভারতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক পতিত জায়গা আছে। এসব জায়গায় অনায়াসে কাঁকড়ার খামার গড়ে তোলা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করা হলে কাঁকড়া উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয়ও বাড়ানো সম্ভব হবে। কাঁকড়া
রপ্তানিকারকরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কাঁকড়া রপ্তানিতে বন বিভাগের অনাপত্তিপত্র লাগে। এই অনাপত্তি পত্র পেতে রপ্তানিকারকদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ ছাড়া কাঁকড়া আহরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় রপ্তানিকারকদের। এসব সমস্যার সমাধান হলে সম্ভাবনাময় এই শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনীতিতে সূচিত হবে নতুন অধ্যায়।
খুলনা পাইকগাছার কপোতাক্ষ পাড়ের শিববাটি এলাকার চাষি রঞ্জন কুমার ম-ল (৩৮) কয়েক বন্ধুর সঙ্গে মিলেমিশে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যৌথ কারবারে সুবিধা করতে না পেরে নিজে হ্যাচারি করার উদ্যোগ নেন। এতেও নানা রকম বিপত্তি দেখা দেয়। এমন সময় পাইকগাছা নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্র থেকে কাঁকড়া চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন কাঁকড়া ফ্যাটেনিং বা চাষ।
নিজের পাঁচ কাঠা জমির ওপর একটি পুকুরে তিনি কাঁকড়ার চাষ করছেন। তাও ১০-১২ বছর হবে। এটাই এখন তার আয়ের একমাত্র উৎস। কেমন আয় হয়-জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আয় সব সময় সমান হয় না। কখনো বেশি, কখনো কম হয়। তবে যা-ই হয়, তাতে সংসার চলে যায়।’ তিনি জানান, এখানকার প্রায় সবাই সারা বছর কাঁকড়ার চাষ করেন। তবে ১০ বছরেরও বেশি সময়ের কাঁকড়া চাষি রঞ্জন জানান, জ্যেষ্ঠ থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত কাঁকড়ার ভালো চাষ হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেছেন, কাঁকড়া একটি সম্ভাবনাময় খাত। এজন্য এটিকে একটি নীতিমালা ও সমন্বয়ের মধ্যে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম