কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নড়াইল জেলার নদী ও খাল-বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ক্রমশ লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে আশপাশের জমির উর্বরতা কমছে। ফলে কৃষি উৎপাদন কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে কমছে মাছের উৎপাদন। সমুদ্রে পানির উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সদর ও কালিয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নড়াইলের প্রাকৃতিক পরিবেশ বৈরী হয়ে উঠছে।
যশোর মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, উপকূলের নিকটবর্তী হওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে দেশের যেসব অঞ্চল অধিক ঝুঁকির মধ্যে, তার মধ্যে নড়াইল অন্যতম। শুষ্ক মৌসুমে সমুদ্র থেকে লবণাক্ত পানি জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে ঢুকে পড়ছে। এতে পানি আটকাতে সেচ সুবিধার জন্য নির্মিত স্লুইস গেট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে যেসব এলাকায় স্লুইস গেট নেই, সেসব এলাকায় খাল দিয়ে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে প্রবেশ করছে। এতে প্রতি বছর বিস্তীর্ণ এলাকা অনাবাদি হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে এসব জমি স্থায়ীভাবেই অনুর্বর হয়ে পড়ছে।
এসডিআরআইয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকতা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১০ বছর আগে নড়াইলে কোথাও লবণাক্ততা দেখা যায়নি। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে এ জেলার কিছু কিছু অঞ্চলে ফসলি জমি ও নদীর পানিতে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে এবং দিন দিন এর পরিধি বাড়ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে রিভার্স অসমোসিসের ফলে উদ্ভিদ পানি গ্রহণ করতে না পারায় মরে যায়। এতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কালিয়া উপজেলার চাকই গ্রামের কৃষক আমজেদ আলী জানান, জমিতে লোনা পানি ঢুকে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ১০ বছর আগে এমন হতো না। ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেছে।
পিরোজপুর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক বিধান কুমার ভাণ্ডার বলেন, বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত কৃষিজমির মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন করতে কৃষকরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে। এতে একদিকে যেমন তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা তার।
সূত্র জানায়, জলবায়ুর পরিবর্তনে বর্ষাকালেও বৃষ্টিপাত কমে গেছে। এ কারণে পাট, আমন, এমনকি আউশ ধান চাষেও কৃত্রিম সেচের প্রয়োজন পড়ছে। তবে অনেক সময় বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যার পানিতে ফসলের মাঠ তলিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণায়নের ফলে শীত দেরিতে আসায় রবি শস্যের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সদর ও লোহাগড়া উপজেলায় পানি সংকট দেখা দিচ্ছে।
একসময়ের খরস্রোতা মধুমতি ও নবগঙ্গাসহ জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে চর জেগে উঠেছে। ফলে নাব্য সংকটে বিখ্যাত বড়দিয়া ও শিয়রবর নদীবন্দর অচল হয়ে পড়েছে। নৌপথ অকার্যকর হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে অসংখ্য লোক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়েছে। সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণহানি ছাড়াও জেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে সদর ও কালিয়া উপজেলার প্রায় ২০ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
ঋতু পরিবর্তনে প্রকৃতির স্বাভাবিক মেজাজ বদলে যাওয়ায় মত্স্য সম্পদসহ জীববৈচিত্র্যও হারিয়ে যেতে বসেছে। বৃষ্টির অভাবে বিগত বছরগুলোয় ডিম ছাড়ার মৌসুমে খাল-বিলে পানি না থাকায় বিভিন্ন দেশী প্রজাতির মাছ বংশ বিস্তার ঘটাতে পারেনি। ফলে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে অন্তত ৩৫ প্রজাতির মাছ। বাকি প্রজাতিগুলোও পড়েছে চরম সংকটে। ফলে মাছের উৎপাদন কমায় বেকার হয়ে পড়েছেন জেলেরা। স্থানীয় জেলেরা জানান, আগে নদী, খাল, বিল ও বিভিন্ন উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন অনেক মাছ পাওয়া যায় না। গত ১৫ বছরে টেংরা, বোয়াল, পাবদাসহ অন্তত ১০ প্রকার দেশীয় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ফলে অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।
সদরের গোবরা গ্রামের জেলেপাড়ার বাসিন্দা কার্তিক জেলে জানান, একসময় এ গ্রামে প্রায় ৪৫০টি জেলে পরিবার ছিল। তখন সবাই চিত্রা নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন নদীতে লোনা পানি আসায় মাছ পাওয়া যায় না। ফলে অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করেছেন। এখন গ্রামে মাত্র ৪০-৫০ ঘর জেলে আছে।
জেলা মত্স্য কর্মকর্তা হরিপদ মণ্ডল বলেন, দেশের সব জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মত্স্য চাষের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নড়াইলও তার ব্যতিক্রম নয়। মিঠা পানিতে যেসব মাছ ভালো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেই পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেলে মাছের ক্ষতি হয়। লোনা পানিতে যে মাছ চাষ হয়, লবণাক্তাতা বাড়লে সেসব মাছের ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না। তাই যেসব এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেসব এলাকার মত্স্যচাষীর কথা চিন্তা করে এরই মধ্যে কিছু লবণসহিষ্ণু জাতের মাছ উদ্ভাবন করা হয়েছে। বর্তমানে নড়াইলে প্রায় সাত হাজার জেলে আছেন। এছাড়া ১১ হাজারের বেশি মানুষ মত্স্য চাষে জড়িত। আমরা চাষীদের লবলসহিষ্ণু জাতের মাছ চাষের পরামর্শ দিচ্ছি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খালে, বিলে ও নদীতে যেসব মাছ অবশিষ্ট আছে, তাদের আবাসস্থল ঠিক রেখে প্রজনন ঘটিয়ে আমরা এসব জাত টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আমিনুল হক বলেন, নড়াইল জেলার আবহাওয়া দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে বিলে লবণাক্ততা বাড়ছে। কৃষকদের কথা চিন্তা করেই এরই মধ্যে কিছু লবণসহিষ্ণু জাতের ধানের জাত, যেমন— ব্রি-৪৭, ব্রি-৫৩, ব্রি-৬১, ব্রি-৫৪ উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেসব এলাকার জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে, সেসব এলাকায় কৃষককে এসব জাতের ধান আবাদে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কৃষকরাও এসব জাতের ফসলের আবাদ করে ভালো ফলন পাচ্ছেন।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/ এম ইসলাম