ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া: সব ঋতুতেই এদেশে কোন না কোন ফুল ফোটে৷ তবে সব ঋতুতেই যে ফুলের চারা বা বংশ বিস্তারক্ষম একক লাগানো হয় তা কিন্তু নয়৷ সাধারণত বর্ষাকালে বহু বর্ষজীবী ফুল গাছের চারা লাগানো হয়৷ তবে বছরের বিশেষ বিশেষ ঋতুতে সুদৃশ্য বর্ষজীবী ফুল উত্পাদনের লক্ষ্যে যেসব বিরুত্ এবং কোমলাঙ্গী উদ্ভিদের আবাদ করা হয় এদের মরসুমী ফুল বলা হয়৷ বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এদের কোন জুড়ি নেই৷ মরসুমী ফুলের বর্ণ বৈচিত্র্য এদের এক বিশিষ্টতা দান করেছে৷ বছরের বিশেষ ঋতুতে এরা বাগানে ফুলের বাহার নিয়ে আসে বলে এরা ‘ঋতু বাহার’ নামেও পরিচিত৷ এক বছর বা তার চেয়েও কিছু বেশি সময় এদের জীবন কাল৷ স্বল্প সময়ে বাগানের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্যই মরসুমী ফুলের এত কদর৷
মরসুমী ফুলের গাছ সাধারণত অনুচ্চ কোমলকান্ড বিশিষ্ট এবং কোন কোনটা লতানো স্বভাবের৷ এক সময়ে এসে সব গাছে একত্রে ফুল ফোটে বলে এদের এত আকর্ষণ৷ এরা বর্ষজীবী হলেও এদের ফুল ফোটে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে এসে৷ সে সময় বাগানে রঙের যেন ঢল নামে৷ বাগানের বৃত্তাকার বা বর্গাকার নির্দিষ্ট অংশে ভিন্ন ভিন্ন ফুল গাছের সারিবদ্ধভাবে বিন্যাসিত ফুল গাছগুলোতে যখন এক স্থানে একই সময়ে ভিন্ন রঙের ফুল ফোটে সে এক অনুপম দৃশ্য হয়ে ওঠে৷ আর তা যদি ক্রমান্বয়ে ভেতরের বড় গাছ বাগানে থেকে ক্রমান্বয়ে বাইরের প্রান্তের দিকে গাছগুলোর উচ্চতা ছোট হতে থাকে তবে তো আর কথাই নেই৷ সে রকম প্রস্ফুটিত মরসুমী ফুলের বর্ণ বৈচিত্র্য এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে৷ বুঝি একেই অনুপম সুন্দর বলে আখ্যায়িত করা হয়৷ মরসুমী ফুলের সুখ্যাতি মূলত এদের বর্ণ বৈচিত্র্যের জন্য৷ এদের অধিকাংশেরই ফুল আসলে গন্ধহীন৷ এদের অনেকেই একবার ফুল সৃষ্টি করেই গাছ মারা যায়৷ সে কারণে এদের অনেকেই ওষধি গাছ৷ কোন কোন মরসুমী গাছ অনুকূল পরিবেশ পেলে অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে আর বিশেষ বিশেষ ঋতুতে এরা ফুল উত্পাদন করে৷ অনেকটা দেখতে এদের কোন কোনটা গুল্মের মতই তবে এদের কান্ড কাষ্ঠল নয়৷
মৌসুমী ফুলের প্রায় সবই বিদেশী৷ পৃথিবীর নানা ভৌগোলিক পরিবেশে এদের উত্পত্তি ঘটেছে৷ কখনো উত্পত্তি স্থল থেকে, কখনো আবার অন্য কোন দেশ থেকে এদের এদেশে প্রবর্তন করা হয়েছে৷ সকলের পরিবেশিক চাহিদা তাই এক রকমের নয়৷ এদের মধ্য থেকেই কোন কোনটা আমাদের পরিবেশে কোন কোন ঋতুতে বেশ ভালই মানিয়ে নিয়েছে৷ তবে এদের অধিকাংশই ঠান্ডা ও তুলনামূলকভাবে শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে বলে শীতকালই এদের অধিক পছন্দ৷ অবশ্য বিদেশী কিছু কিছু ফুল আবার আমাদের বৃষ্টি ভেজা ঋতুর জন্যও বাছাই করে নেওয়া হয়েছে৷
মরসুমী ফুল আসলে তিন রকমের৷ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস পর্যন্ত ফুল ফোটার জন্য যে ফুল গাছ লাগানো হয় এদেরকে রবি মরসুমের ফুল বলা হয়৷ এদের অবশ্য শীতকালীন ফুলও বলা হয়৷ এ সময়ের বিখ্যাত ফুলগুলো হলো কার্ণেশন, ক্রিসেন্থেমাম বা চন্দ্রমলি্লকা, অ্যান্টারহিনাম, ডালিয়া, চায়না পিংক, গাঁদা, এস্টার, কসমস, জিনিয়া, পিটুনিয়া, লুপিন, হলিহক ইত্যাদি৷ বিদেশ থেকে আনা বীজ থেকে চারা গাছ তৈরি করে নিয়ে এদের রোপন করা হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে৷ জুন থেকে জুলাই-আগস্ট সময় কালে ফুল ফুটবে এই আশায় যেসব ফুল গাছ রোপন করা হয় এরা হলো খরিফ মরসুমের ফুল৷ এদের অবশ্য বর্ষাকালীন ফুলও বলা হয়৷ বর্ষাকালীন ফুলের মধ্যে রয়েছে মোরগ জবা, বোতাম ফুল, দোপাটি, অপরাজিতা ইত্যাদি৷ সময় মত ফুল পেতে হলে এদের বীজ এপ্রিল মে মাসেই বীজ তলায় বপন করা শ্রেয়৷ কোন কোন মরসুমী ফুল গাছ আবার সারা বছরই বাঁচে কিন্তু ফুল ধারণ করে কেবল একটি বিশেষ সময়ে এসে৷ সে কারণেই এদের বলা হয় দীর্ঘজীবী মরসুমী ফুল৷ ডালিয়া, গাঁদা, চন্দ্র মলি্লকা, সন্ধ্যামণি এসব জনপ্রিয় ফুলগুলো হলো এ শ্রেণীর৷
অধিকাংশ মরসুমী ফুলের চাষাবাদ করা হয় বীজ দিয়ে৷ কোন কোন ফুল গাছের বীজ সরাসরি মাঠে বুনে দিয়ে ফুল গাছের আবাদ করতে হয়৷ এদের বীজ থেকে উত্পাদিত চারা গাছ বীজতলা থেকে সরিয়ে বাগানে লাগালে এরা রোপনজনিত আঘাত সহজে কাটিয়ে উঠতে পারেনা বলে সরাসরি বাগানে এদের বীজ বুনে দিতে হয়৷ এদের মধ্যে রয়েছে সুইটপি, পপি, লুপিন ইত্যাদি ফুল গাছ৷ বেশির ভাগ মরসুমী ফুল গাছ আসলে জন্মানো হয় বীজতলায় চারা তৈরি করে৷ তবে চন্দ্রমলি্লকা, গাঁদা, ডালিয়া এসব জনপ্রিয় ফুলগাছগুলোর বংশ বিস্তার করা হয় প্রধানত অঙ্গজ চারা ব্যবহার করে৷ প্রাকৃতিকভাবে এদের কোন কোনটা বীজও তৈরি করে৷ তবে বীজ দিয়ে বংশ বিস্তার করলে পর-পরাগায়নের মাধ্যমে সৃষ্ট বীজের গাছ তার মাতৃ-গুণাগুণ বজায় রাখতে পারে না৷ সে কারণে এদের অঙ্গজ বংশবিস্তারই অধিক কাম্য৷
সুন্দর নকশা অনুযায়ী মরসুমী ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগানে সত্যি সত্যি একটি ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করা যায়৷ মরসুমী ফুল গাছ লাগাবার বহু রকমের নকশা হতে পারে৷ বাগানের স্থানে স্থানে মরসুমী ফুল জন্মানোর জন্য ফুলের কেয়ারী সৃষ্টি করতে হয়৷ হাঁটা পথের দু’পাশে কিংবা সীমানা দেয়াল ও সবুজ হেজের সামনে অধিকাংশ কেয়ারী করতে হয়৷ এসব কেয়ারীর আকার আকৃতি বহু রকমের হতে পারে৷ গোলাকার, অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিভুজাকৃতি, বর্গাকার, আয়তাকার এমনি সব কেয়ারী দেখা যায় প্রায়শই৷ এসব কেয়ারীতে নানা রকম নকশা করে লাগানো যায় ফুলের গাছ৷ বৃত্তের ভেতরে আরও বৃত্ত কিংবা বৃত্তকে অবলম্বন করে বাইরে ছোট ছোট অর্ধচন্দ্রাকারও হতে পারে নকশা৷ একই ভাবে ত্রিভুজের ভেতরে ত্রিভুজ, বর্গাকার ক্ষেত্রের ভেতরে ক্রমশ ছোট হয়ে আসা একাধিক বর্ণ কিংবা আয়তকার ক্ষেত্রে নানা রকম অাঁকাবাঁকা নকশাও হতে পারে৷
নকশা ধরে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের ফুল গাছ লাগানো সম্ভব প্রতিটি কেয়ারীতেই৷ কোন ধরনের ফুল গাছ বাইরের সারিতে আর কোনটাবা ভেতরের সারিতে থাকবে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তা কেবল সাজানো সম্ভব৷ সাধারণ নিয়ম এই যে ভেতরের দিকে থাকবে সবচেয়ে উঁচু প্রকৃতির মরসুমী ফুল গাছ৷ কখনো কখনো গুল্ম জাতীয় পত্রল কোন গাছকে কেন্দ্র করেও ক্রমান্বয়ে সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয় নানা উচ্চতার গাছ৷ একেবারে বাইরের সারিতে থাকে সবচেয়ে অনুচ্চ ফুলের গাছ৷
কেবল উচ্চতাই প্রধান বিষয় কেয়ারীতে মরসুমী ফুলের চাষে তা কিন্তু নয়৷ কোন রঙের ফুলের পাশে কোন রঙের ফুল মানাবে সে বর্ণ পরিকল্পনাও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ একই রঙের বিভিন্ন গাছের ফুল এক কেয়ারীতে জন্মানোর কোন মানে হয় না৷ বরং কোন রঙের পাশে অন্য কোন রঙের সঠিক উচ্চতার গাছ কেয়ারীর কোন সারিতে লাগাতে হবে তা একটি রীতিমত শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়৷ রঙ ও উচ্চতা অনুযায়ী গাছ নির্বাচন খুব সহজ কাজ নয়৷ এর জন্য ফুলের প্রজাতি আর জাতের খবর যেমন জানতে হয়, জানতে হয় সঠিক রূপকল্প ধরে এদের কেয়ারীতে সাজানোর বিষয়টিও৷ এ এক রীতিমত উচ্চমাত্রার শিল্প কর্ম৷ বাগানে অন্য বহুবর্ষী গুল্মের সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে নানা উচ্চতার গাছের বিন্যাসের পাশাপাশি বিসদৃশ অথচ বর্ণচ্ছটা বাড়িয়ে দেয় তেমন রঙের ফুলের সজ্জা পরিকল্পনা মরসুমী ফুলের রঙ মাধুর্যতার মিশেলে এক চমত্কার চিত্ররূপ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব৷ পরস্পরকে প্রশমিত নয় বরং পরস্পরকে আরো উজ্জ্বলতা প্রধানই হবে বর্ণ রূপকল্পের আসল উদ্দেশ্য৷ বর্ষার ফুলের কেয়ারী জমি থেকে একটু উঁচু হতে হবে আর শীতের ফুলের জন্য তা কিছুটা নিচু হলেই ভাল হয়৷
কত ভিন্ন ভিন্ন কারণেইনা মরসুমী ফুলের আবাদ করা হয়৷ কখনো কখনো বৃক্ষ বা গুল্মের গোড়ার খালি জায়গা ঢেকে রাখার জন্যও এদের চারপাশে লাগিয়ে দেওয়া হয় মরসুমী ফুল গাছ৷ টবে ও ঝুলানো ঝুঁড়িতেও মরসুমী ফুলের আবাদ করা যায়৷ টব তৈরি হতে পারে মাটি, কাঠ, কংক্রিট, সিরামিক, ধাতু কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে৷ পাতলা, সস্তা এবং দেখতে সুন্দর হয় বলে আজকাল মাটির পরিবর্তে প্লাস্টিকের টব ব্যবহৃত হচ্ছে৷ ঝুলানো অবস্থায় গাছ জন্মাবার জন্য পাতলা টব বা ঝুঁড়ি হলে ভাল হয়৷ প্লাস্টিকের টব বা ঝুঁড়ি এ কাজে খুবই সহায়ক৷ টবের বা ঝুলানো ঝুঁড়ির জন্য ফুল গাছ নির্বাচন করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ সাধারণভাবে টব বা ঝুঁড়ি রাখার স্থান কিছুটা কম আলো পায়৷ কোন কোন সময় খোলা বারান্দা বা উন্মুক্ত কোন সূর্যালোক শোভিত স্থানে টব বা ঝুঁড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকলে ভিন্ন রকম উদ্ভিদ প্রজাতি বাছাই করার প্রয়োজন হয়৷
আলোর প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে নানা রকম মরসুমী ফুল পরিবেশ অনুযায়ী বাছাই করতে হয়৷ পূর্ণ আলোকিত স্থানে মরসুমী ফুল টবে আবাদের উপযোগী ফুল গাছগুলো হলো স্ন্ন্যাপ ড্রাগন, চন্দ্রমলি্লকা, ডালিয়া, কার্ণেশন, স্যালভিয়া, গাঁদা ইত্যাদি৷ কোন কোন গুল্মও টবের জন্য বেশ মানানসই৷ মুক্তোঝুড়ি, চিংড়ি ফুল, লঙ্কা জবা, গোলাপ ও নয়নতারা এসব ফুল গাছ টবের জন্য মানানসই গুল্ম৷ লতানো ফুল গাছের মধ্যে উলট চন্ডাল, হাওয়া লতা এবং কুঞ্জলতা টব বা ঝুঁড়িতে লাগানো যায়৷ কিছুটা ছায়াযুক্ত স্থানের টবের জন্য উপযোগী গাছ হলো সন্ধ্যামণি, এলোকেশি এসব গাছ৷
ঝুলানো ঝুঁড়ির জন্য গাছগুলো ছোট আর আকর্ষণীয় ফুল সম্পন্ন হওয়াই বাঞ্ছনীয়৷ পিটুনিয়া, অর্কিড সহ নানা রকম ছোট ছোট ঘাস ফুল এর জন্য অতি উত্তম৷ আমাদের দেশে ঝোপঝাড়ে অনেক অনুপম সৌন্দর্য্যমন্ডিত ঝুলানো ঝুঁড়ির উপযোগী ঘাস ফুল রয়েছে যা বাছাই করে নিয়ে এ কাজে ব্যবহার করা যায়৷ তাছাড়া মরসুমী ফুল নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণাও রয়েছে আমাদের দেশে৷ দেশে বিভিন্ন নার্সারীতে বিদ্যমান নানা প্রকার ফুল বিভিন্ন মরসুমে লাগিয়ে দিয়ে বাছাই করে নেওয়া সম্ভব মরসুম ভিত্তিক উত্তম ফুল গাছগুলো৷
মরসুমী ফুলের মধ্যে কোন কোনটা কাটা ফুল হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চন্দ্রমলি্লকা, কার্ণেশন ও স্ন্যাপ ড্রাগন৷ কোন কোন মরসুমী ফুলের পাঁপড়ি শুষ্ক প্রকৃতির হওয়ায় এসব ফুল ফোটার সাথে সাথে বোঁটাসহ কেটে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে এদের ফুল অনেক দিন অমলিন ও আকর্ষণীয় অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়৷ অনেক দেশেই এভাবে সংরক্ষিত ফুল থেকে ফুলদানী বা ফুলের তোড়া সাজানো হয়৷ এরকম সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত বিদেশী ফুল হলো বোতাম ফুল, কাগজ ফুল, হেলিপ্টেরাস, জেরান্থেমাম ইত্যাদি৷ মরসুমী ফুল সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে আমাদেরও অন্য মরসুমে এদের ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে৷
লেখকঃ প্রফেসর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ এবং প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭।
কৃপ্র/এম ইসলাম