কৃষিবিদ ড. মো: শাফায়েত হোসেন: সভ্যতার সূচনাই হচ্ছে কৃষি দিয়ে। তাই বলা হয় কৃষিই কৃষ্টির মূল। পূর্বে কৃষিক্ষেত্র ছিল উপেক্ষিত। আজকাল এর উপর বেশ জোর দেয়া হচ্ছে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। এটা একটা ভাল লক্ষণ। বীজ হচ্ছে কৃষি উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন উপকরণ। কৃষি কর্মকান্ড বীজ ছাড়া কল্পনাই করা যায় না, আর তা হতে হবে ভাল বীজ। ”ভালবীজে ভালফসল” এ স্লোগান আজ সকলেই উপলব্ধি করতে পেরেছে জন্য একদিকে যেমন আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ভাল বীজের জন্য উদ্গ্রীব অন্যদিকে বিভিন্ন বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের দিকে ঝুকে পড়ছে। যদিও কিছু বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত বীজের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যা হোক কিছুদিন পূর্বেও বিদেশ থেকে আমদানীর মাধ্যমে বীজের চাহিদার বিরাট অংশ পূরণ করা হতো।
বর্তমানে চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে গেলেও বিদেশ থেকে বীজ আমদানী আনুপাতিক হারে অনেক কমে গেছে। সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে পূর্বের চেয়ে ভাল বীজের উৎপাদন বৃদ্ধিই এর মূল কারন। দেশের বিভিন্ন কৃষি ও বীজ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কৃষি গ্রাজুয়েটদের ভূমিকা এখানে মূখ্য। বাংলাদেশে বীজ শিল্প হচ্ছে সরকারী ও বেসরকারী সেক্টরের সমন্বিত উদ্যোগ। বেসরকারী সেক্টরে সারা দেশে শতাধিক বীজ কোম্পানী, বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং ৬০০০ এর বেশী রেজিষ্টার্ড বীজ ডিলার এ শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে। বিএডিসি কে পূনর্গঠনের মাধ্যমে পূর্বের তুলনায় অনেকগুণ বেশী মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদনের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
বীজ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বীজ শিল্পের বিকাশ ওতোপ্রতভাবে জড়িত। বীজ প্রযুক্তি একটি অত্যাধুনিক বিষয় এবং এ বিষয়ে কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষা নেবার সুবিধা এখনও দেশে তেমন সৃষ্টি হয়নি। কৃষি বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিদ্যমান বীজ সম্বন্ধীয় যে পাঠ্যক্রম রয়েছে তা আধুনিক বীজ প্রযুক্তি বিষয়ে সার্বিক শিক্ষা প্রদানে পর্যাপ্ত নয়। অসম্পূর্ণ পাঠ্যক্রম পড়ে পাশ করা ছাত্ররা অসম্পূর্ণ বীজ প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। ফলে বীজ ব্যবস্থায় (শিক্ষা, গবেষনা, সম্প্রসারন,উৎপাদন, বিপনণ) এক ধরনের মৌলিক অদক্ষতা রয়েই গেছে।
জাতীয় বীজনীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের বীজশিল্প অধিকতর বহুমুখী এবং গতিশীল হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বীজ কর্মকান্ড কে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং বীজ সেক্টরকে গুরুত্বের সংগে বিবেচনা করছে। বীজশিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে বীজনীতিতে বিভিন্ন কাজের দিক নির্দেশনা দেবার সাথে সাথে বীজ সংগঠন সমূহের করনীয় সম্পর্কে পরিস্কার ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বীজ শিল্প উন্নয়নের সাথে বীজনীতির ১১নং অনুচ্ছেদে ৮টি সরকারী সংগঠনের কার্যাবলীর কথা বলা হয়েছে। সংগঠন সমূহ হচ্ছে জাতীয় বীজ বোর্ড (ঘঝই), কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইং, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (ইঅউঈ), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী(ঝঈঅ), জাতীয় কৃষি গবেষণা পদ্ধতি (ঘঅজঝ), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (উঅঊ), কৃষি তথ্য সার্ভিস(অওঝ) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ সমস্ত সংস্থার কার্যক্রম বর্ণনাকালে বেসরকারী পর্যায়ে বীজ শিল্প উন্নয়নের জন্য কি করতে হবে তার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর এ সম¯ত সংগঠনের সফলতা নির্ভর করছে দক্ষ বীজ প্রযুক্তিবিদ তৈরী এবং এদের কার্যক্রমের উপর।
বীজনীতির আলোকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যে সকল কার্যাবলী সম্পাদন করবে তা হচ্ছে ১. বীজ প্রযুক্তি বিষয়ে একটি পাঠ্যক্রম প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী করবে যাতে বীজ প্রজনন থেকে পরিবর্ধন এবং বিতরণ, বীজনীতি এবং বীজ উন্নয়ন পর্যন্ত বীজ সংক্রান্ত সকল বিষয় অন্তর্ভূক্ত থাকবে। ২. এর বীজ পরীক্ষাগারটিকে জাতীয় বীজ পরীক্ষাগার হিসেবে উন্নীত করবে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্মকান্ডের পাশাপাশি বীজ সঙ্গনিরোধ প্রয়োজনীয়তা নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা এবং সুস্থ বীজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে। ৩. সরকারী এবং বেসরকারী উভয় খাতে সীম জাতীয় বীজের জন্য ইনোকুলাম প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং উৎপাদন ত্বরান্বিত করবে।
জাতীয় বীজনীতিতে বীজ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্ব পরিস্কারভাবে উল্লে¬খ করা হয়েছে। এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান যে, গবেষণা ও উন্নয়ন, বীজ উৎপাদন, মান নিশ্চয়তা এবং বিপণন কর্মসূচির আধুনিকায়নে উচ্চশিক্ষা ও গবেষনা এবং প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নাই। বীজ নীতিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের কথা উল্লেখ থাকলেও ২০০৭ সালে গঠিত বীজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (ঝববফ ংপরবহপব ধহফ ঞবপযহড়ষড়মু) বিভাগে পি-এইচ,ডি প্রোগ্রামে মাত্র ১জন ছাত্রকে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে, এখন মোট ২ জন ছাত্র অধ্যায়নরত রয়েছে, এম,এস পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ এগিয়ে । এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সালে বীজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে এম.এস এবং পি-এইচ,ডি প্রোগ্রামে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালু হয়, ইতোমধ্যে ৮ জন এম.এস ডিগ্রী এবং ১৭ জন পি-এইচ,ডি অর্জন করেছে। ১২ জন এম.এস প্রোগ্রামে এবং ১৫ জন অধ্যায়ন/গবেষণারত রয়েছেন।
এখানে বীজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়টি স্বয়ংসম্পূর্ন বিভাগ (উবঢ়ধৎঃসবহঃ) হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও, এখনও কৃষিতত্ত্ব (অমৎড়হড়সু) বিভাগের আওতায় “বীজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইউনিট” (ঝববফ ঝপরবহপব ধহফ ঞবপযহড়ষড়মু টহরঃ) নামে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত করছে। স্বয়ংসম্পূর্ন বিভাগের আওতায় শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম যাতে পরিচালিত হয় বিষয়টি নিয়ে সংশি¬ষ্ট সকলকে গুরুত্বের সংগে ভাবতে হবে। জানা গেছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও বীজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি একটি ভাল উদ্যোগ। বিভিন কৃষি প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষ করে বিএডিসি, বিভিন্ন কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠান, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রেষণে কর্মকর্তা/বিজ্ঞানীগন এবং বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশকৃত কৃষি গ্রাজুয়েটগণ এ দুই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বীজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু করলেও তারা স্ব স্ব দপ্তর থেকে প্রেষনাদেশ (উবঢ়ঁঃধঃরড়হ) প্রাপ্তিতে প্রশাসনিক জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন ফলে অনেকেই এক পর্যায়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
সুপারিশ: * বীজ প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরীর ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদানে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা/বিজ্ঞানীদের কোটাভিত্তিক বৃত্তির ব্যবস্থা চালু করা এবং বীজ প্রযুক্তিগত আধুনিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে।
* সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার জন্য ঘুর্ণায়মান তহবিল সৃষ্টি করা।
* কৃষি মন্ত্রনালয়ের প্রতিটি প্রকল্পে বর্ণিতখাতে আলাদা বাজেট বরাদ্দ রাখা এবং বীজ উইংকে উহা কার্যকরী করার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা নেয়া।
* বীজ সংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি আরো জোরদার করার জন্য আলাদা বীজ এম,আই,এস (ঝববফ গওঝ) সৃষ্টি করা।
* প্রতিটি সরকারী ও বেসরকারী বীজ প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও উন্নয়ন (জ্উ) টেকসইভাবে চালু করা।
কৃপ্র/এম ইসলাম