‘১৯২ প্রজাতির ঔষধি গাছের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে বিএফআরআই’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ একসময় শুধু আয়ুর্বেদিক কিংবা ইউনানিনির্ভর হলেও বর্তমানে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কারখানায়ও ঔষধি গাছের ব্যবহার বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে চাহিদা বাড়লেও দেশে ঔষধি গাছের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে সমন্বিত কোনো গবেষণাকর্ম এখনো পরিচালিত হয়নি। কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে দেশে ঔষধি গাছের একটি বড় অংশ পড়েছে বিলুপ্তির শঙ্কায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ-বিষয়ক একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি গাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে বিএফআরআইয়ের তিন বছর মেয়াদি এ গবেষণা কার্যক্রম শুরু হবে চলতি বছরের জুলাইয়ে।
বিএফআরআইয়ের তথ্যমতে, প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ঔষধি গাছ রয়েছে তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে। কিন্তু এ-বিষয়ক সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ কারণে অঞ্চলটিতে ঔষধি গাছের সঠিক তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে ‘এক্সপ্লোরেশন, ডকুমেন্টেশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব মেডিকেল প্লান্টস ইউজড বাই দ্য এথনিক কমিউনিটিজ অব চিটাগং হিলট্র্যাক্টস, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণাকাজ হাতে নিয়েছে বিএফআরআই। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় ঔষধি গাছের অন্বেষণ ও এর সঠিক পরিচয় চিহ্নিত করা হবে। পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর এসব গাছ ব্যবহারের ধরন ও তাদের কাছ থেকে এ-সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত জ্ঞান আহরণ এবং সংগৃহীত গাছ সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
বিএফআরআইয়ের গৌণ বনজ সম্পদ বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল হায়দার বণিক বলেন, উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্থানে সীমিত পরিসরে চাষাবাদ হলেও ঔষধি গাছের বাণিজ্যিক প্রসার এখনো হয়নি। বাণিজ্যিক চাষাবাদ দেশে ওষুধ শিল্পের প্রসারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ঔষধি গাছের প্রধান উত্স। গুরুত্ব বিবেচনায় আমরা আগামী জুলাই থেকেই দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করছি। জীবন রক্ষাকারী এসব ঔষধি গাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে এরই মধ্যে বিশাল সংগ্রহশালা তৈরি করেছি আমরা, সারা দেশে এর সম্প্রসারণই যার মূল লক্ষ্য।
জানা গেছে, এরই মধ্যে ১৯২ প্রজাতির ঔষধি গাছের সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে বিএফআরআই। আগামী তিন বছরের মধ্যে এতে সংরক্ষিত প্রজাতির সংখ্যা ৫০০-এ উন্নীত করার পরিকল্পনাও রয়েছে সংস্থাটির। বিএফআরআইয়ের গবেষকরা জানান, ঔষধি গাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা ও ওষুধ শিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে এ সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে সংরক্ষণ করা হয়। এতে বর্ষজীবী প্রজাতির গাছের বীজ সংরক্ষণ করা হয়। আর বহুবর্ষী গাছ বাঁচাতে এর চারা সংরক্ষণ করা হয় এ প্রতিষ্ঠানে। এসব বীজ ও চারাগাছকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চায় বিএফআরআই।
বিএফআরআইয়ের এ উদ্যোগ দেশের ওষুধ শিল্পের জন্যও অনেক ইতিবাচক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দেশীয় ঔষধি গাছ শনাক্তকরণ ও এর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের আমদানি নির্ভরতা অনেকাংশে কমে আসবে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামভিত্তিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত বলেন, একসময় ঔষধি গাছ বলতেই ইউনানি কিংবা আয়ুর্বেদিকের বিষয়টি সামনে আসত। কিন্তু এখন অ্যালোপ্যাথিকেও এর চাহিদা বাড়ছে। পরিসরের দিক থেকে এখনো এর ব্যবহার ছোট হলেও এক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। গাছের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলে সামগ্রিক ওষুধ শিল্পের জন্যই তা ইতিবাচক হবে।
জানা গেছে, দেশের ওষুধ শিল্পে তুলসী, শতমূলী, অশ্বগন্ধাসহ বিভিন্ন ঔষধি গাছের ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এর প্রথম বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয় নাটোরের খোলাবাড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফরিদপুর, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের আরো কয়েকটি জেলা। এসব অঞ্চলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও একমি ল্যাবরেটরিজ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে কিছু ঔষধি গাছের আবাদ করছে। এরই মধ্যে তুলসী পাতা দিয়ে তৈরি ‘অ্যাডোভাস’ নামের একটি ওষুধ বাজারে এনেছে স্কয়ার। আর ইউনানি ওষুধ কোম্পানি, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ, ফার্মাজেম, বিজি ল্যাবরেটরিজ, এপি, কুণ্ডেশ্বরী, সাধনা, শক্তি ঔষধালয়সহ বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি গাছ ব্যবহার করে আসছে।
গবেষকরা জানান, দেশে বর্তমানে বাসক, শতমূলী, অশ্বগন্ধা, কালোমেঘ, তুলসী, অ্যালোভেরা, ভুঁইকুমড়া, ওলটকম্বল, হরীতকী, বহেড়াসহ বেশকিছু ঔষধি গাছের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। এছাড়া এরই মধ্যে শনাক্ত হয়েছে এমন ঔষধি গাছের মধ্যে রয়েছে— মেষশৃঙ্গ, অঞ্জন, আফিম, আম আদা, ইঞ্চি লতা, উইলো, উদয়পদ্ম, কদম, কপসিয়া, করবী, করলা, কলকাসুন্দা, কাঁঠাল, স্বর্ণলতা, কাকমাচি, হন্ধা, হাড়জোড়া, হিবিস্কাস, কালমেঘ, কুঁচ, কুরচি ফুল, কুলঞ্জন, কুলেখাড়া, সরিষা, কোকা, সাদা ভেরেন্ডা, ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস, খইয়া বাবলা, খযরে, গন্ধভাদালি লতা, গলগল, গাঁজা, গাব, গামারি, সর্পগন্ধা, গালানগল, চন্দ্রমল্লিকা, চালতা, চিরতা, চই, ছোট আকন্দ, জবা, জারুল, জিনসেং, টগর ট্রাইকোসানথেস, ডাকুর, ডিজিটালিস, আমলকী, আলকুশি, আশশেওড়া, ডুলিচাঁপা, ঢোল কলমি, তাম্রচূড়া, তিল, তেঁতুল, তেলাকুচা, আকন্দ, আগর, দইগোটা, স্বর্ণচামেলী, দাঁতরাঙ্গা, দাদমর্দন, দূর্বা, দেবদারু, দেশী গাব, দেশী রাস্না, ধনে, ধুতরা, নয়নতারা, নিম, নিশিন্দা, নীল রাস্না, নীলবনলতা, পটোল, পদ্ম, পাতি হলিহক, পাথরকুচি, পাথুনি শাক, বারসুঙ্গা, বাসক, বিজয়া সুখদর্শন, বিষকাটালী, বেদানা, বেল (ফল), ব্রহ্ম কমল, মধুপায়ী ধাইরা, মরু সরিষা, মাকাল, মাখনা, মাধবীলতা, মিশ্রিদানা, মুক্তঝুরি, মেথি, মেহেদি, ল্যাভেণ্ডার, ব্রাহ্মী, শিকোরি, শিরিষ, সজনে প্রভৃতি।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম