কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিচ্ছিন্ন একটি ইউনিয়ন গাবুরা। কথা হয় ইউনিয়নের লক্ষ্মীখালী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব সাফিয়া খাতুনের সঙ্গে। পানিভর্তি হাতের বালতি রেখে কপালের ঘাম মুছে সাফিয়া খাতুন বলেন, পানির মধ্যে বসবাস করলেও আশপাশে খাওয়ার জন্য একফোঁটা পানিও নেই। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিনই তাকে আড়াই মাইল দূর থেকে পানি আনতে হয়। ব্যবহারের পানিও এক মাইল হেঁটে পুকুর থেকে নিয়ে আসেন। এ পরিস্থিতি শুধু সাফিয়া খাতুনের নয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও বাগেরহাটের মংলা, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রতিদিন সকালে ছোটে সুপেয় পানির সন্ধানে। সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূলবর্তী এ অঞ্চলের মানুষ অপেক্ষায় থাকে বৃষ্টির। বৃষ্টি হলে সুপেয় পানিবঞ্চিত এসব মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রতিবেদন বণিক বার্তা।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী শেখ সরফরাজ আলী বলেন, এখানকার মানুষের প্রধান ভরসা বৃষ্টির পানি। নদীর পানি দিয়ে মাছ চাষ করায় পুকুরগুলোর পানি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই এলাকার পানি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারিভাবে প্রতিটি ইউনিয়নে একাধিক পুকুরের পাড়ে পানি বিশুদ্ধকরণের বিশেষ প্লান্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় আশির দশকে উপকূলের বাঁধ কেটে ফসলি জমিতে লোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করেন খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলের কৃষক। সে সময় চিংড়ি চাষ করে লাভবান হচ্ছিলেন তারা। দেশের চিংড়ি জয় করে ইউরোপ-আমেরিকার বাজার। চিংড়ি রফতানিকে কেন্দ্র করে দেশের পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে ওঠে বহু প্রতিষ্ঠান। ‘হোয়াইট গোল্ড’ খ্যাতি পাওয়া চিংড়ি রফতানি করে রাতারাতি ধনবান হয়েছে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ। কিন্তু দেশের অন্যতম এ রফতানি পণ্যটিই এখন উপকূলে বসবাসকারী মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
যুগের পর যুগ ধরেই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। বাঁধ কেটে লোনা পানি প্রবেশ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, নদীপ্রবাহে বাধা, নদী-খাল দখলসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় এ জেলাগুলোর উপকূলীয় অঞ্চল। প্রলয়ঙ্করী সে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো বেরোতে পারেনি উপকূলের মানুষ। উল্টো দিন দিন বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে সুপেয় পানির হাহাকার চলছে। তীব্র পানি সংকটে থাকা ইউনিয়নগুলোর মধ্যে রয়েছে— শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, আঠুলিয়া, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, আশাশুনির প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়ন। এসব ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রামের মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে খাওয়ার ও ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করছে।
সুপেয় পানির অভাবে বিপর্যস্ত একটি জনপদ শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়ন। সুন্দরবনঘেরা ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান বলেন, পুরো ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। দীর্ঘ পথ হেঁটে এলাকার মানুষকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কিছু এনজিও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও পুকুর খনন করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কয়েক বছর ধরে এনজিওগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু তথ্যই সংগ্রহ করছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।তিনি বলেন, সরকারি বরাদ্দ না থাকার কারণে উপকূলের বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা যাচ্ছে না। যেকোনো ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভেঙে পুরো ইউনিয়নে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মংলা, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ উপজেলায়ও। কয়রা উপজেলার কয়রা সদর ইউনিয়ন, আমাদী, বাগালী, মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন, পাইকগাছা উপজেলার হরিঢালী, গদাইপুর, রাড়ুলী, লতা, দেলুটি, সোলাদানা, লস্কর, চাঁদখালী, গড়ইখালী ইউনিয়ন, দাকোপ উপজেলার পানখালী, লাউডোব, কৈলাসগঞ্জ, সুতারখালী, কামারখোলা, তিলডাঙ্গা, বাজুয়া ও বানীয়াশান্তা ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামেই কমবেশি পানি সংকট চলছে।
পাইকগাছা পৌরসভার মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর জানান, সরকারের বিশেষ উদ্যোগ ছাড়া এত বড় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। পানি সংকট নিরসনে উপজেলাব্যাপী বড় বড় পুকুর খনন করা দরকার। এছাড়া পর্যাপ্ত গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমেই পানি সংকট কমিয়ে আনতে হবে। উপকূলের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, মিঠা পানির সংকটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় লোনা পানির কারণে গাছ মরে শুকিয়ে গেছে। দুই বছর ধরে মানুষ নতুন করে গাছ লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আগের মতো প্রকৃতিতে সজীবতা নেই। গাছ সংকটে জ্বালানি কাঠেরও তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মানুষ সুন্দরবনের কাঠের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বিপন্ন হয়ে উঠবে সুন্দরবনের গাছও।
সুপেয় পানি সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ গৃহপালিত অন্যান্য পশু-পাখির ওপর। পরিসংখ্যানমতে, সাতক্ষীরা জেলায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পালিত মোট গরুর সংখ্যা ছিল সাড়ে চার লাখ। অথচ এক দশক আগেও জেলাটিতে পাঁচ লাখেরও বেশি গরু উৎপাদন হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের লক্ষ্মীখালী গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব গাজী আবুল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে ওই গ্রামের প্রত্যেক ঘরেই গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালিত হতো। কিন্তু সুপেয় পানির অভাব ও খাদ্য সংকটের কারণে এখন পুরো গ্রামে ২০টি গরুও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আশির দশকের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বর্তমানে যেসব জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে, সেগুলোয় নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত ধান চাষ হতো। গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের গোলাভরা ফসল ছিল। কিন্তু এখন পুরো গ্রামে এক ইঞ্চি জমিও ধান চাষের উপযুক্ত নেই। নদীর লবণাক্ত পানি ঘেরে ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করার কারণে এখন অন্য ফসল হারিয়ে গেছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর ক্ষতি সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী এলাকার মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতাসহ লবশাক্ত পানির কারণে সুপেয় পানির সংকট চলছে। সংকট উত্তরণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে তা সমস্যার তুলনায় অপ্রতুল। তিনি বলেন, পার্বত্য এলাকার মতো উপকূলবর্তী ১৬টি জেলার উন্নয়নের জন্য আলাদা বোর্ড গঠনের প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। এটি বাস্তবায়ন হলে উপকূলের মানুষের সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে।
দীর্ঘ সময় খুলনা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব হিসেবে যোগ দিয়েছেন নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, খুলনার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহে প্লান্ট স্থাপনের চেষ্টা চলছে। রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্লান্ট আরো বাড়ানোর চেষ্টা চলমান। এছাড়া পুকুরগুলো পুনঃখননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে সুপেয় পানির সংকট অনেকাংশে কেটে যাবে।
কৃপ্র/এম ইসলাম