কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ পবিত্র রমজানে ইফতারে শত রকমের আইটেম সাজালেও তালিকায় প্রথম থাকে মুড়ি। এই রমজানে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের গৃহিণীরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মুড়ি ভাজার কাজে। ব্যস্ততার পাশাপাশি তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশাও। পুঁজি সংকট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না মেশিনে ভাজা মুড়ির সাথে। নারান্দিয়া অঞ্চলের কুড়িরা বাব-দাদার এই পেশা ছেড়ে এখন অনেকে অন্য পেশায় চলে গেলেও কিছু মানুষ ধরে রেখেছেন এ পেশাকে।
দৌলতপুর ও মাইস্তা গ্রামে দেখা মিলে তাদের। গ্রাম দু’টির চার শতাধিক পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেন হাতে মুড়ি ভেজে। পুরুষেরা বাজারজাত করলেও মুড়ি ভাজার সকল কাজ করেন নারীরাই। এছাড়াও নারান্দিয়াতে রয়েছে মুড়ি ভাজার চারটি মিল। এই মিলগুলোর কারণে হাতে ভাজা মুড়ির কদর কমে যাচ্ছে। তারপরেও হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদার যেন শেষ নেই। গ্রাম দু’টিতে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মণ মুড়ি ভাজা হয়। মুড়ি ভাজার জন্য স্থানীয় ভাষায় চাল খোলা, বালু খোলা, ঝাইনজোর, চালুন, ছামনি ও পাটকাটি নামক সরঞ্জাম মুড়ি ভাজার কাজে ব্যবহার করতে হয়। মাটির তৈরি পাত্রগুলো বাজারে কুমার বা পালদের কাছে পাওয়া যায়। একটি পাত্রে বালি ও একটি পাত্রে লবণ পানি মেশানো চাল রেখে চুলায় আগুনে তাপ দিতে হয়। পরিমাণ মতো তাপ শেষ হলে চাল বালির পাত্রে ঢেলে ঝাকুনি দিয়ে পাশের ছামনিতে বসানো ঝাইজোরে (তলা ছিদ্র যুক্ত পাত্র) ঢেলে দেয়া হয়। তারপর চালা দিয়ে চেলে বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকেই গৃহিণীরা এই মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। অনেকে চালা (ছাকুনি) দিয়ে চালিয়ে মুড়ি থেকে বালি ছাড়াচ্ছে, কেউ বস্তা ভরছেন। ব্যবসায়ীরা নারান্দিয়ার মুড়ি ট্রাক ও পিকআপ যোগে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, গাজীপুর, ঢাকা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছেন। এছাড়া স্থানীয় পাইকার ও মহাজনরা (মুড়ি ব্যবসায়ী) বাড়ি বাড়ি গিয়েও তাদের কাছ থেকে মুড়ি ক্রয় করেছেন।
মাইস্তা গ্রামের সাজেদা বেগম জানান, ‘মেশিনের মুড়ি বাজারে আসলেও আমাদের এই হাতে ভাজার মুড়ির স্বাদ ও চাহিদা এখনো আছে। একজন ব্যবসায়ী আমার কাছে ৩শ’ মণ মুড়ি নিবে বলে আমাকে টাকা দিয়ে গেছে প্রতিবার রোজা আসলেই আমার কাছ থেকে মুড়ি নিয়ে তিনি ঢাকায় বিক্রি করেন। একই গ্রামের প্রমেলা বেগম বলেন, আমি ভোর থেকে এই মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করি, সকাল ১১টা পর্যন্ত এই মুড়ি ভাজার কাজ করি। এই কয় ঘন্টায় এই মুড়ি ভাইজা আমরা প্রতিদিন তিন-চারশ’ টাকা আয় করতে পারি’। এই মুড়ির টাকা দিয়েই আমার সংসার চালে। কুলসুম জাহান বলেন, আমি ৩০ বছর ধইরা এই হাতে ভাজার মুড়ি কাজ করি। এই হাতের ভাজা মুড়ি বিক্রি করে আমার তিনটা মেয়ারে বিয়ে দিছি। দুইটা বাড়ি করছি কয়েক কাঠা জমিও করছি। আমার বয়স হইছে, এখনো মুড়ি ভাজা বাদ দেই নাই। আমার টাকা দিয়াই আল্লাহর রহমতে সংসার চলছে।
রানী দাস বলেন, এই যে আমি অসুস্থ ডাক্তারে কইছে এক্কেবারে আগুনের কাছে যাওয়া যাবো না। কিন্তু কি করমু আগুনে যদি না যাই তাইলে খামু কি। সরকার যদি আমাগো কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতো তাহলে আমরা ভালো করে চলতে পারতাম। মুড়ি ব্যবসায়ী রফিক শিকদার বলেন, আমি প্রায় ১৫ বছর যাবত এই মুড়ি ব্যবসায় জড়িত। আমি ভোরে ঢাকা রওনা দেই সকালে এসে নারান্দিয়ায় পৌঁছাই। সকালে সবার বাড়িতে গিয়ে মুড়ি কিনে তার পর ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করি। হাতে ভাজা এই মুড়িতে কোন রকম ভেজাল নেই। এই মুড়িতে শুধু লবন-পানি ছাড়া আর কিছু দেয়া হয় না। তাই এই নারান্দিয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির অনেক স্বাদ ও এই মুড়ির চাহিদাও অনেক।
এ বিষয়ে কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু বলেন, কালিহাতীর নারান্দিয়ার হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা এবং সুখ্যাতি শুধু টাঙ্গাইলে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানেও রয়েছে। নারান্দিয়ার বাজারে মুড়ির স্থায়ীবাজার তৈরি করা হবে। যাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আসা ব্যবসায়ীরা এই বাজার থেকে মুড়ি কিনে নিতে পারেন। মুড়ি তৈরি, বাজার সম্প্রসারণ ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এর সঙ্গে জড়িতদের যে কোনো সহযোগিতা করা হবে বলেও তিনি জানান।
সুত্রঃ বাসস / কৃপ্র/এম ইসলাম