ড. মো. হুমায়ুন কবীরঃ বছর পরিক্রমায় চাঁদের হিসাবে প্রতিবছর ১১দিন করে রমজান এগিয়ে আসে। সেভাবে প্রতি ৩৩ বছরে একটি বছরচক্র ঘুরতে দেখা যায়। সেজন্য ঘুরে ফিরে সারাবছরই রমজান ঘুরে ঘুরে আসে। কাজেই একজন মানুষের জীবদ্দশাইে সব ঋতুতেই রমজানের রোজার স্বাদ পাওয়া যায়। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের রমজান মাসের রোজা শুরু হয়েছে একেবারে পুরোপুরি গরম কালে। এমন গরম যে তা সহ্য করা কঠিন। একদিকে গরমের দিন অন্যদিকে লম্বা দিন- দুটোই রোজা রাখার জন্য একটু কষ্টের বলেই মনে করছেন অনেকে। কিন্তু রমজানের রোজার মধ্যে সরাসরি আল্লাহ তায়ালার রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বিষয়টি জড়িত থাকার কারণে কোন কষ্টই রোজাদার মুসল্লীগণ কষ্ট হিসেবে দেখেন না। তারপরও এমন কঠিন দিনে রোজা রাখতে গিয়ে কিছু বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছণীয়।
এখন সেহরির শেষ সময় যদি ৩টা ৪০মিনিট ধরি এবং ইফতারের সময় ৬টা ৪৫মিনিট ধরি তাহলে মোট রোজা রাখার সময় হলো ১৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট। এমনিতেই এত ধীর্ঘ সময়, তারউপর আবার প্রচ- অসহ্য গরম। এটি মানুষের শরীর স্বাস্থ্যের উপর বিরাট একটি চাপ। সাধারণত রমজানের খাদ্যের চাহিদার জন্য ক্ষুধার চেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেয় পানির তৃষ্ণা পাওয়া নিয়ে। সেসময় শরীরে পানির পিপাসায় প্রচ- চাহিদা থাকে। সেজন্য সেই পানি পান করার উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হয় সেহরি ও ইফতারের সময়।
আমরা বাঙালি হিসেবে খুবই রসনা বিলাসী। আর রমজান হলে তো আর কোন কথাই নেই। পাড়াতে পাড়াতে মহল্লায় মহল্লায় বাড়িতে বাড়িতে যেন ইফতারের বাহারি আইটেম বানানো নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সেখানে ইফতারের আইটেম হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থান পায় ভাজাপোড়া জাতীয় রসনার জন্য মুখরোচক অতি আকর্ষণীয় খাবার। হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাট যেখানেই যাওয়া যায় সেখানেই সেসব সাজানো ইফতারের আইটেম চোখে পড়ে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ইফতারে এসব মুখরোচক ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বরং সারাদিন রোজা রাখার পর পেটে যেসব খাবার সহজপাচ্য তা না গ্রহণ না করে এসব খাওয়া স্থাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
কারণ রোজার সময় রোজার কষ্ট কিছুটা লাঘব করার জন্য সরকারি বেসরকারি সকল অফিস আদালত পর্যন্ত কাজের সময় কমিয়ে দিয়ে থাকে। কারণ রোজার মধ্যে ভারী এবং কষ্টের কাজ না করাই ভালো। সেখানে দু’বারে একটু স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া খুবই জরুরি। সে খাবারগুলো খুবই দামি হতে হবে এমন নয়। সেগুলো পুষ্টি সমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত হলেই যথেষ্ট। তাই সেহরি এবং ইফতারে খাবারের আইটেমগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এখন সাধারণত সেহরিতে খাই বড় বড় দামি দামি মাছ মাংস ডিম, দুধ কলা, আম, পোলাও কুরমাসহ আরো বাহারি উচ্চ প্রোটিন এবং তৈলাক্ত খাবার-দাবার। কিন্তু নিয়মিত এগুলো পরিহার করে অনিয়মিতভাবে কয়েকদিন পরপর স্বাভাবিক সকল খাবারের সাথে পর্যায়ক্রমে মাছ মাংস ডিম দুধ পোলাওসহ অন্যান্য খাবার খেতে হবে। তাতে পেটের পাকস্থলীকে হজমের জন্য কিছু সময় দেওয়া যায় এবং আন্ত্রিক যন্ত্রাংশগুলো সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে। সেহরি খাওয়ার উপরই যেহেতু সারাদিনের রোজার ধকলটি নির্ভর করে সেজন্য সেসময় খাবারে পুষ্টি পরিকল্পনা থাকলে ভালো হয়। সেখানে নানারকম মৌসুমী ফলমূলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও আঁশ জাতীয় খাবার থাকা প্রয়োজন। আর পানির কথাতো না বললেই নয়। একেবারে সেহরির শেষ সময় পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে পরিমিত পরিমাণ পানি পান করা বাধ্যতামূলক। তা না হলে দিনশেষে শরীরে পানির টান পড়তে বাধ্য।
তেমনিভাবে ইফতারের সময়ও সুচিন্তিত ইফতারের আইটেম গ্রহণ করতে হবে। সেখানে পবিত্র পূণ্যভূমির ফল হিসেবে পরিচিত খেজুরতো থাকবেই। সেইসাথে লেবু চিনির শরবত, ফ্রিজের বরফ ঠা-া পানি, নরম খাবার ইত্যাদি প্রয়োজনমত গ্রহণ করতে হবে। শরবত কিংবা অন্যান্য ইফতার জাতীয় খাবারের সাথে অতিরিক্ত কৃত্রিম রঙ পরিহার করতে হবে। কারণ এসব রঙ শরীর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ইফতারের অনেক বাহারি আইটেমের জন্য অনেক বিখ্যাত স্থান রয়েছে যেখানে মনোলোভা বিভিন্ন আইটেম পাওয়া যায়। এসব বিশেষ আইটেমগুলো শুধু সেই এলাকায় নয় বরং সারাদেশেই এগুলোর ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন ঢাকার চকবাজারের মনোহর বাহারি ইফতার। এগুলো প্রতিদিনই টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে জিহ্বায় জল আসে ঠিকই কিন্তু তা দুয়েকদিনের বেশি খাওয়া ঠিক নয়। তাতে বদহজম হয়ে রোজা রাখার উপর প্রভাব পড়তে পারে। এভাবে দেখে-শুনে খেলে একদিকে যেমন রোজাগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালন করা যায়, অপরদিকে পরিমিত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ব্যবহারের অভ্যাস করতে পারলে রমজান মাসে অহেতুক নিত্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি না হয়ে বরং দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। তাতে সবারই মঙ্গল।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়