কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বিগত বছরের তুলনায় সাতক্ষীরায় এবার আমের উৎপাদন বেশি। কিন্তু চাহিদা অবিশ্বাস্য রকম কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আট-দশ বছরের মধ্যে আমের বাজারে এত মন্দা তারা দেখেননি। সব জাতের আমই এবার গতবারের প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে। তার পরও যথেষ্ট ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমচাষী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তো বটেই, অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হতে চলছেন।
সাতক্ষীরা শহরের বদ্দিপুর এলাকার আম ব্যবসায়ী রুহুল আমীন জানান, চলতি মৌসুমে ৬ লাখ টাকা দিয়ে চারটি আমবাগান কিনেছেন। এসব বাগানে হিমসাগর, ল্যাংড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির তিন শতাধিক আমগাছ রয়েছে। এসব গাছের আম এখন তাকে পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। যে হিমসাগর গত বছর ২ হাজার ৬০০ টাকা মণ বিক্রি করেছেন, তা এখন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে। ল্যাংড়া গেল মৌসুমে ৩ হাজার টাকা মণ বিক্রি হলেও এবার ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। লতা, বোম্বাই ও সিঁদুরমেঘসহ অন্যান্য জাতের আমেরও একই দশা।তিনি বলেন, এরই মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ আম বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু ৬ লাখ টাকায় বাগান কিনে এ পর্যন্ত বিক্রি করতে পেরেছেন মাত্র ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। প্রায় ৩ লাখ টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি।
জেলা সদরের সুলতানপুর বড়বাজারের কয়েকটি আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ আড়তে প্রচুর আম রয়েছে। সে তুলনায় পাইকার বা ক্রেতার উপস্থিতি নেই। সরবরাহের তুলনায় ক্রেতাস্বল্পতার কারণে পানির দরে বিক্রি হচ্ছে আম।এ বাজারের অন্যতম আড়ত মর্জিনা ট্রেডার্সের মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, গত এক দশকে আমের এত কম দাম তিনি দেখেননি। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে কয়েক দিন আমের বাজার একটু ভালো গেলেও চারদিক থেকে যখন বাজারে আম আসতে শুরু হলো, তখন থেকেই দর পড়তে থাকল। জেলার বাইরে থেকেও এবার পাইকার আসছে খুব কম। যে কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে আম বিক্রি করতে হচ্ছে।
পুরাতন সাতক্ষীরার রবিউল ইসলাম, ২০ বছর ধরে আম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতি মৌসুমে তিনি বাগান কেনেন। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ঢাকায়ও আম পাঠান। তিনি জানান, ২০০০ সালের পর থেকে গত বছর পর্যন্ত তিনি হিমসাগর প্রতি মণ গড়ে আড়াই হাজার টাকা, ল্যাংড়া ৩ হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০, আম্রপালী, গোপালভোগ ও অন্যান্য গড়ে ২ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছেন। সেখানে এবার হিমসাগর সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা, ল্যাংড়া ১ হাজার ৬০০ এবং অন্যান্য জাতের আম ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। সুলতানপুর বড়বাজারের মানিক ফল আড়তের স্বত্বাধিকারী মতিয়ার রহমানও একই কথা জানান। তিনিও কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে আমের ব্যবসা করছেন কিন্তু এমন বিপদে কখনো পড়েননি। ব্যবসায়ীরা জানান, অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ঋণ করে বাগান কিনেছেন। তাদের এখন পথে বসার জোগাড়।
আমের বাজার এভাবে পড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা জানান, অন্যবারের তুলনায় এবার আমের ফলন ভালো। কিন্তু সে তুলনায় চাহিদা কম। তাছাড়া সরকার আম সংগ্রহের সময় বেঁধে দেয়ায় সব বাগানের আম একসঙ্গে বাজারে এসেছে। একে তো উৎপাদন বেশি, তার ওপর একসঙ্গে আম সংগ্রহের কারণে সরবরাহ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছে। ফলে স্বভাবতই দামও পড়ে গেছে। সাতক্ষীরায় আম সংগ্রহের সরকার নির্ধারিত সময় ১ মে থেকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলার ৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬০২, তালায় ৭০৫, দেবহাটায় ৩৬৮, কালীগঞ্জে ৮০৫, আশাশুনিতে ১২৫ এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১৫০ হেক্টর। এসব আমের মধ্যে রয়েছে ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, ফজলি, আম্রপালী, সিঁদুরমেঘ, লতা ও অন্যান্য। আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫১ হাজার টন, যা গত বছরের ২০ শতাংশ বেশি।সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ কাজী আব্দুল মান্নান জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় আম উৎপাদন যেকোনোবারের তুলনায় খুবই ভালো। কিন্তু সে অনুযায়ী চাষীরা দাম পাচ্ছেন না। যদিও সাতক্ষীরার হিমসাগর, ল্যাংড়া ও মল্লিকা আম বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদনের তুলনায় সেটি একেবারে নগণ্য।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম