ডাঃ মনোজিৎ কুমার সরকার: থাইলেরিয়াসিস গবাদিপশুর রক্তবাহিত এক প্রকার প্রোটোজোয়াজনিত রোগ। এই জীবাণু গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে থাইলেরিয়াসিস রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। থাইলেরিয়ার জীবাণু আক্রান্ত গরু থেকে সুস্থ গরুতে আঠালির মাধ্যমে এ রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকাল আঠালির প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময়। এ কারণে গ্রীষ্মকালে গরু আঠালি দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং দ্রুত রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে থাইলেরিয়াসিস দেখা যায়। Theileria গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রোটোজোয়া দ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে গরুতে Theileria annulata আক্রান্তের হার খুব কম হলেও মৃত্যু হার প্রায় ৯০-১০০%। এ রোগের ক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পশুর রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব নীচে নেমে যায়। ফলে রোগটি নির্ণিত হওয়ার পর চিকিৎসা দিলেও গরুকে সুস্থ করে তোলা প্রায়ই সম্ভব হয় না। তাছাড়া মাঠপর্যায়ে গরুর রক্ত পরিবহন বাস্তবে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ রোগের চিকিৎসার জন্য উন্নতমানের ঔষধের দাম খুব বেশি এবং তা সর্বত্র সহজে সব সময় পাওয়া যায় না। এ কারণে থাইলেরিয়াসিস অর্থনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রোগ সঙ্কর জাতের গরুতে বেশি দেখা যায়। সঙ্কর জাতের একটি গাভীর দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। গবাদিপশুর খামারের ক্ষতিকর রোগগুলির মধ্যে থাইলেরিয়াসিস একটি অন্যতম রোগ। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এ রোগ দেখা যায়। বিভিন্ন কারণে থাইলেরিয়া রোগ নির্ণয় করতে অনেক সময় লেগে যায়। খামারীদের কাছাকাছি এলাকায় প্রায়শ রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থাকে না। থাইলেরিয়া রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা মূল্যের গো-সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে।
রোগের জীবন চক্র
থাইলেরিয়া রোগের মাধ্যমিক পোষক হিসাবে কাজ করে প্রায় ছয় প্রজাতির আঠালি। যথা- Rhipicephalus Spp, Hyalomma Spp, Boophilus Spp, Haemophysalis Spp ,Ornithodoros Spp, Dermacentor Spp
বাংলাদেশে প্রধানত Hyalomma Spp -এর আঠালি Theileria annulata প্রোটোজায়ার মাধ্যমিক পোষক হিসাবে কাজ করে। থাইলেরিয়া আক্রান্ত আঠালির লালা গ্রন্থির মধ্যে অবস্থিত Sporozoits রক্ত শোষণকালে সুস্থ গরুর দেহে প্রবেশ করে। পরে লসিকা গ্রন্থি ও প্লীহার লসিকা কোষকে আক্রান্ত করে ম্যাক্রোসাইজোন্ট বা ককস্-ব্লু বডি (Koch’s blue bodies) সৃষ্টি করে যা মাইক্রোসাইজোন্ট-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোসাইজোন্ট লোহিত কণিকাকে আক্রান্ত করে পাইরোপ্লাজম সৃষ্টি করে। রক্ত শোষণের সময় এই পাইরোপ্লাজম আঠালির দেহে প্রবেশ করে। আঠালির দেহের মধ্যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে আঠালির লালা গ্রন্থিতে অবস্থান নেয় যা পরে গবাদিপশুর রক্ত শোষণকালে প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে। আক্রান্ত আঠালি সুস্থ গরুকে কামড়ানোর ৭-১০ দিন পর পশুর দেহে তাপ দেখা দেয়।
রোগ লক্ষণ
গরুর প্রবল জ্বর (১০৪-১০৭০ ফা), ক্ষুধামান্দ্য, রক্তশূন্যতা, চোখ দিয়ে পানি ঝরা, রুমেনের গতি হ্রাস, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, রক্ত ও আম মিশ্রিত ডায়ারিয়া ও নাসিকা থেকে শ্লেম্মা নির্গত হয়। এ সময় গরু শুকিয়ে যায় এবং কোনো এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসায় ফল পাওয়া যায় না। দুধ উৎপাদন একদম কমে যায়, গরু শুয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে, হাঁপায় এবং ধীরে ধীরে গরুর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে হঠাৎ করে গরুর শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। সাধারণত আক্রান্ত হবার ১৮-২৪ দিন পর প্রাণী মারা যায়। থাইলেরিয়ায় আক্রান্ত প্রাণী চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলে কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে তবে প্রাণীটি এ রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে।
রোগ নির্ণয়
রোগের লক্ষণ, ইতিহাস এবং চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রাথমিক ভাবে এই রোগ নির্ণয় করা যায়। ল্যাবরেটরিতে আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত জেম্সা স্টেইন করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পাইরোপ্লাজম দেখে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
রোগ নির্ণয়ে বেশি দেরী হলে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় না। দ্রুত রোগ নির্ণয় করে মাত্রামত Buparvaquone, Diminazene diaceturate ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। সহায়ক চিকিৎসা হিসাবে ভিটামিন ই১২ ইনজেকশন, Hartmann’s Solution ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। সম্ভব হলে রক্ত সংযোজন করতে হবে যা দূরূহ ব্যাপার। আক্রান্ত প্রাণীর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খাওয়াতে হবে। পশুকে ছায়াযুক্ত আরামদায়ক পরিবেশে রাখতে হবে। প্রচুর ঠান্ডা পানি পান করতে দিতে হবে।
প্রতিরোধ
ডেইরী খামারীদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে থাইলেরিয়া রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। যে কোন মূল্যে পশুর খামারকে উকুন, আঠালি ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। গোয়াল ঘর ও এর চতুর্দিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রতি ৪ মাস অন্তর গাভীকে আঠালি প্রতিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগ করে আঠালি মুক্ত রাখতে হবে। গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে দুই বার গোয়াল ঘরে আঠালিনাশক ঔষধ মাত্রামত সপ্রে করলে গোয়াল ঘর আঠালি মুক্ত থাকে। আক্রান্ত এলাকার সন্দেহজনক সকল গবাদিপশুকে Buparvaquone, Diminazene diaceturate ইত্যাদি প্রতিশেধক হিসাবে মাত্রামত প্রয়োগ করা উচিত।
লেখক: ডাঃ মনোজিৎ কুমার সরকার, ভেটেরিনারি সার্জন,উপজেলা পশুসম্পদ অফিস, রংপুর।
কৃপ্র/এম ইসলাম