কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
দেশের নিউজিল্যান্ড খ্যাত জনপদ শাহজাদপুরসহ পাবনা-সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন দুগ্ধসমৃদ্ধ এলাকায় অসংখ্য ভেজাল দুগ্ধ ব্যবসায়ী ও অসাধু ঘোষ দৈনিক হাজার হাজর লিটার তরল দুধে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করে সড়ক পথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে আসছে। তারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দুধের রং, সুবাস ও সোয়াবিন তেল মিশ্রণ করে ফ্যাট সৃষ্টির মাধ্যমে বেসরকারি বিভিন্ন ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারে সরবরাহ করছে। ভেজাল ওই দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দেশের নামিদামি ব্রান্ডের নামে মোড়কীকরণ করে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো হচ্ছে। খবর যায়যায় দিন অনলাইনের।
গত বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত্ম উলস্নাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আরিফুজ্জামানের নেতৃত্ব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে নকল দুধ তৈরি, ক্রয়-বিক্রয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুধ সংগ্রহ, মিষ্টিজাত খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত ও সরবরাহের অভিযোগে মোহনপুরস্থ আকিজ ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারকে ১০ হাজার, প্রাণের ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারকে পাঁচ হাজার, আড়ং ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারকে পাঁচ হাজার, বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভা-ারকে পাঁচ হাজার, এবং অপর দুই মিষ্টি ব্যবসায়ীকে দুই হাজার টাকা করে সর্বমোট ২৭ হাজার টাকা জরিমানা আদায় এবং গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের ভেজাল ওষুধ কারখানায় অভিযান চালিয়ে মোহনপুরের দীকেন্দ্রনাথ চন্দ্রের ছেলে কারখানা মালিক অমরেশ চন্দ্রকে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান চলাকালে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, উলস্নাপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু সুফিয়ান, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত্ম) গোলাম মোস্ত্মফা ও সেনেটারি ইন্সপেক্টর শহীদুল ইসলাম।
এর আগে গত মঙ্গলবার পাবনার ডেমরায়ও দুধ ক্রয়কেন্দ্রগুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে বলে জানা যায়। উলেস্নখ্য, দীর্ঘদিন ধরে কাপড় কাঁচা ডিটারজেন্ট পাউডার, সয়াবিন তেল, সোডা, স্যালাইন, চিনি, গুঁড়োদুধসহ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিভিন্ন কেমিকেল দিয়ে ভেজাল ও নকল শিশুখাদ্য (দুধ) তৈরি করে আকর্ষণীয় মোড়কে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করে আসছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, ‘কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল দুধ পান করে শিশুসহ আমজনতার কিডনি, লিভারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত্ম হবার ঝুঁকি অত্যন্ত্ম বেশি। এজন্য এ অঞ্চলে ভেজাল দুধ তৈরিকারীদের প্রতিরোধে ‘গুরম্ন পাপে লঘু দ-‘ এর পরিবর্তে ‘গুরম্ন পাপে গুরম্ন দ-‘র আইন প্রচলন অতীব জরম্নরি হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, শাহজাদপুর, উলস্নাপাড়ার মোহনপুর ও ফরিদপুর থানার ডেমরা ইউনিয়নের পালপাড়া সংলগ্ন এলাকায় ভেজালকারীরা প্রথমে দুধ থেকে ক্রিম তুলে ঘি তৈরি, এরপর টানা দুধ দিয়ে ছানা তৈরি ও তার পরে ছানার পানির সাথে ফরমালিন, কাটিং ওয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও দুধের সুবাস তৈরির জন্য অ্যাসেন্স মিশিয়ে ভেজাল দুধ বিক্রি করে তিনভাবে লাভবান হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের প্রচলিত আইনের ফাঁকফুকুর থাকায় ওই আইন প্রয়োগের ফলে এবং প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারির অভাবে দুগ্ধসমৃদ্ধ এ জনপদের বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টার স্থাপনের পর থেকে এ অপকর্ম চলে আসছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গবাদিপশুসমৃদ্ধ পাবনা-সিরাজগঞ্জের পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ফরিদপুর, ডেমরা, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, উলস্নাপাড়া, রায়গঞ্জ, তাড়াশ এলাকাসহ বাঘাবাড়ী মিল্কশেড এরিয়া (পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর) থেকে প্রতিদিন প্রায় চার লাখ লিটার টাটকা তরল দুধ সংগৃহীত হয়। সংগৃহীত ওই দুধের একাংশ দেশের সর্ববৃহৎ সমবায়ী প্রতিষ্ঠান ‘মিল্কভিটা’য় চলে যায়।
দিনে লাখ লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হওয়ায় শাহজাদপুরে মিল্কভিটার পাশাপাশি ব্যাঙ্গের ছাতার মতো ১৪টি বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্টের দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আর ওই কেন্দ্রগুলো স্থাপিত হওয়ার পর থেকে ভেজালকারী ওই চক্রটি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কেমিক্যাল মিশ্রণ করে ভেজাল দুধ উৎপাদন করে কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করতে শুরম্ন করে। প্রথমে এ ভেজাল দুধের ব্যাপারে ওইসব কুলিং সেন্টারের অনেক কর্মকর্তারাও অজ্ঞ ছিলেন। পরে বিষয়টি অপেন সিক্রেট হওয়ার পর থেকে বিপুল অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে তারাও জনস্বাস্থ্যেকে জিম্মি করে ভেজাল দুধ সরবরাহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছেন।
স্থানীয় দুগ্ধ ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে লিটারপ্রতি দুধের দাম ও এক কেজি গো-খাদ্যের দামের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য তারতম্য না থাকায় পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার দুগ্ধসমৃদ্ধ এলাকা শাহজাদপুর, বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ফরিদপুর, ডেমরা, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, তাড়াশ ও রায়গঞ্জের তরল দুধ ব্যবসায়ীদের অনেকেই খাবার পানির সাথে, ছানার পানির সাথে ময়দা ও চিনি জ্বাল দিয়ে তাতে ফরমালিন, কাটিং ওয়েল, পার অক্সাইড, খাইসোডা ও দুধের ননী মিশিয়ে নকল দুধ তৈরি করছে। তারা প্রতি ৩৭ লিটার খাবার পানিতে ৩ লিটার দুধের ননী, ৫০ গ্রাম খাইসোডা, কয়েক চামচ পার অক্সাইড, ফরমালিন ও কাটিং ওয়েল মিশিয়ে ১ ক্যান (৪০ লিটার) নকল ভেজাল দুধ তৈরি করছে।
দুধ সাধারণত ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার বেশি সতেজ না থাকায় এতে ফরমালিন ও ৪০ লিটার ক্যানে ৩ থেকে ৫ লিটার পানি মেশানো হচ্ছে। এতে ৪৮ ঘণ্টাতেও তৈরিকৃত ভেজাল দুধ নষ্ট হচ্ছে না। ফলে ঢাকা, বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ দেশের দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় তরল দুধ পৌঁছানোর কাজে কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। অভিজ্ঞ মহলের মতে, গুটিকয়েক অসাধু দুগ্ধ ব্যবসায়ীর হাতে দেশবাসী জিম্মি হোক এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ অপকর্ম প্রতিরোধে অবিলম্বে প্রশাসন কর্তৃক ঝটিকা অভিযানের পাশাপাশি কঠোর আইন প্রণয়ন অতীব জরম্নরি হয়ে পড়েছে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে শিশুসহ দেশের আমজনতার স্বাস্থ্যঝুঁকি কোনোভাবেই হ্রাস করা সম্ভব হবে না বলেও তারা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
কৃপ্র/ এম ইসলাম