কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
আমার কিছু বন্ধু এবং পরিচিত মানুষ বাংলাদেশে টিউলিপ থেকে ফুল ফুটিয়েছেন জেনে অনুসন্ধান করলাম ফুল ফোটা এবং না ফোটার কারণ। প্রথমেই মনে হলো টিউলিপের ফুল ফোটানোর পেছনে প্রকৃতি যে কাজগুলো নিয়মিত করে থাকে সে ব্যাপারে কিছু তথ্য আমাদের জানা থাকলে ভালো হয়। তাহলে ফুল ফোটানোর কাজ করাটা সম্ভবত সহজও হবে এবং ভালোও লাগবে।
প্রাকৃতিক নিয়মে গাছ নিয়ত পাতা তৈরি করতে থাকে। এই পাতা থেকেই সাধারণত ফুল তৈরি হয়। পাতা থেকে ফুল তৈরি করার জন্য গাছ এক ধরনের হরমোন তৈরির সংকেত পায়। এই বিশেষ হরমোনটির নাম ফ্লোরিজেন (ভষড়ৎরমবহ)। এটি সাধারণত তৈরি হয় গাছের পাতায়। শীতপ্রধান দেশের পাতা বিহীন গাছ কাণ্ড থেকে ফ্লোরিজেন তৈরি করে। প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রজাতির উপরেও নির্ভর করে এই ফুল ফোটানোর ব্যাপারটা। এমন কিছু প্রজাতির গাছ আছে যারা কিছুদিন কম তাপমাত্রায় না থাকলে ফুল ফোটায় না। কম তাপমাত্রায় আবেষিত হয়ে ফুল ফোটানোর এই প্রক্রিয়াকে বলে ভারনালাইজেশন (াবৎহধষরুধঃরড়হ)। এই শ্রেণির গাছের মধ্যে আছে টিউলিপ, ড্যাফোডিল, হায়াসিন্থ, ক্রোকাসসহ আরও কিছু ফুল। এ ধরনের গাছে ফ্লোরিজেন তৈরি হয় ঠা-ার প্রভাবে। তাই শীতপ্রধান দেশ থেকে আনা বিশেষ কিছু বাল্ব থেকে গাছ হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেই গাছে ফুল আসে না যথেষ্ট ঠা-ার অভাবে বা বলা যায় কোল্ড শকের অভাবে।
টিউলিপ মূলত বর্ষজীবী গাছ ও শীতপ্রধান দেশের বসন্ত্মকালীন ফুল। টিউলিপের প্রায় ১৫০ প্রজাতি এবং এদের অসংখ্য সংকর রয়েছে। টিউলিপ এখনো বাংলাদেশে চাষ করা হয় না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন টিউলিপের ফুল ফোটাতে। কেউ হয়ত সফল হয়েছেন অথবা কেউ ব্যর্থ হয়ে ভাবছেন এ পথে আর এগোবেন না। আমি বলব, হাল ছাড়বেন না, কারণ বাস্ত্মবে এটা সম্ভব। হয়ত কিছুদিন সময় লাগবে টিউলিপ ফোটাতে।
শীতপ্রধান দেশের মতো আপনি একবার টিউলিপ লাগিয়ে বিনা পরিশ্রমে বাকি কয়েক বছর ধরে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না। আপনাকে প্রতি বছর লাগাতে হবে বাল্ব। প্রতি বছর দিতে হবে কোল্ড শক। যদিও হল্যান্ডের বেশিরভাগ গার্ডেনার টিউলিপকে অ্যানুয়াল ফুল হিসেবে জন্মাতে পছন্দ করেন।উন্নতমানের টিউলিপ পাবার জন্য তারা এ কাজটি করেন।
বাংলাদেশে টিউলিপ চাষের সবচাইতে গুরম্নত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় হলো ১) টিউলিপ বাল্বকে মাটিতে লাগানোর আগে অবশ্যই কোল্ড শক দিতে হবে, ২) টিউলিপের বাল্বকে বছরের সবচাইতে ঠা-া সময়ে লাগাতে হবে, ৩) টিউলিপ ফোটা শেষ হয়ে গেলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাল্বকে উঠিয়ে ফেলতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে চাষের জন্য অবশ্যই আবার প্রি-কুল করতে হবে।
আসলে শীতপ্রধান দেশে কোল্ড শক দেয়ার জন্য ফ্রিজে রাখার দরকার পড়ে না, প্রকৃতি স্বাভাবিক নিয়মেই এই কাজটি করে থাকে। এসব দেশের তাপমাত্রা জিরোর নিচে চলে যায় শীতকালে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই ভারনালাইজেশনের কাজ হয়ে যায়। আর সে কারণেই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বাল্বগুলোকে ফ্রিজে রেখে ওদের অনুরূপ একটা পরিবেশ দেয়া দরকার হয়। সুন্দর ফুল ফোটানোর জন্য বেশির ভাগ টিউলিপের ক্ষেত্রে দরকার হয় ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহের শীতল তাপমাত্রা।
গরমের দেশে যেখানে তাপমাত্রা সাধারণত ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামে না এবং কম তাপমাত্রা অনেকদিন স্থায়ী হয় না, সেখানে গার্ডেনাররা আজকাল টিউলিপের বাল্বকে বোকা বানাচ্ছেন ফ্রিজের মধ্যে রেখে। তাদের বুঝতে দেয়া হয় যে তারা ঠা-ার দেশে শীতল মাটির কোলেই ঘুমিয়ে আছে।
টিউলিপরা তাদের চিলিং পিরিওড আরম্ভ করতে পারে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। সেপ্টেম্বরের আগে তারা তাদের শীতনিদ্রার জন্য তৈরি থাকে না। আমরা নিজেরাই তাদের শীতের শক দিতে পারি। এই কাজটা আমরা আমাদের রান্নাঘরের ফ্রিজে রেখে করতে পারি। বাল্বগুলোকে স্টোর করা যায় নিউজপ্রিন্ট দিয়ে পেঁচিয়ে ভেন্টিলেটেড কাগজের ব্যাগে।
অনেকে ভেন্টিলেটেড পস্নাস্টিক বক্সে কিছু মাটি দিয়ে তার উপরে বাল্বগুলোকে শুইয়ে দেন যাতে ওরা মাটিতে থাকার পরিবেশ পায়। কোনোভাবেই বাল্বগুলোকে ফলের পাশাপাশি রাখা যাবে না। কারণ ফল পাকার সময় ইথাইলিন রিলিজ করে যা টিউলিপ বাল্বের ক্ষতি করবে। এদের কোল্ড পিরিওড ডিসেম্বরের ১ তারিখের আগে হতে হবে। ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহ রাখা যেতে পারে ফ্রিজে।
এদের যেখানে লাগানো হবে তার তাপমাত্রার ওপর শীতলীকরণের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। বাল্বগুলো লাগানোর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত্ম ফ্রিজেই রাখতে হবে। এটা খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ। ফ্রিজ থেকে বাল্বকে সরাসরি পস্নান্টিং সাইটে নিয়ে যেতে হবে। সূর্যে আলোর নিচে গরম হওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না। টিউলিপ বাল্ব ৬ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রাতে মাটিতে লাগানো পছন্দ করে। তাতে তাদের শিকড় গজাতে সুবিধা হয়। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ সময় লাগে যথেষ্ট পরিমাণ শিকড় হওয়ার জন্য।
শিকড় গজাবার পর পরই বসন্ত্মের অপেক্ষাকৃত বর্ধিত তাপমাত্রার জন্য তৈরি হয়ে যায় এরা। গরমের দেশে থেকে হেলথি শিকড় গজাতে পারা একটা চ্যালেঞ্জ। যেখানে তাপমাত্রা ১২ এর নিচে নামে না সেখানে ফ্রিজে রেখেই শিকড় গজাতে হবে। যাতে বাল্বগুলো বেশি গরম বা শুষ্ক না হয়। যার যার এলাকার সবচাইতে ঠা-া সময়ে এদের লাগাতে হবে। লাগানো বাল্বগুলকে টবসহ শেডের নিচে রাখতে হবে।
মাটিতে লাগালে, বাল্বের লাগানো স্থানের ওপর কিছু দিয়ে একটি চালার মতো করে দিতে হবে যাতে বাল্ব গরম না হয়ে যায়। নিয়মিত পানি দিয়ে মাটির তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। মাটি হাল্কা ভেজা থাকলে ভালো হয়। টব বা মাটি যেখানেই লাগানো হোক মাটির ড্রেনেজ সিস্টেম ভালো হতে হবে। গাছের গোড়ায় পানি জমলে বাল্ব নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ট্রপিকাল ক্লাইমেটের দেশগুলোতে শীতের সবচেয়ে কনকনে সময়ে মাটিতে লাগানো প্রয়োজন।
কারও মতে বাংলাদেশের অঞ্চল ভেদে দীর্ঘ সময় রাখতে হতে পারে ফ্রিজে। বিশেষ করে ঢাকাতে ১০-১৪ সপ্তাহ এবং সিলেট কিংবা উত্তরাঞ্চলে ৬-৮ সপ্তাহ রাখলেই যথেষ্ট। ঝরঝরে মাটি আর কম্পোস্ট মিশিয়ে লাগালে ভালো ফল পাওয়া যায়। টবে লাগাতে হলে বড় টবে লাগালে ভালো হয়। টবের কেন্দ্রে বেশ গভীরে লাগাতে হবে বাল্বগুলো। কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি মাটির নিচে থাকবে বাল্বগুলো। বাল্ব যাতে বেশি গরম বা উত্তপ্ত না হয়ে যায় সেই কারণে এভাবে লাগানোর দরকার হয়। আংশিক রোদ আর আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে বাল্ব শীতল থাকে যা বাল্বের জন্য প্রয়োজন।
দেশে অথবা বিদেশ থেকে টিউলিপের বাল্ব বা কন্দ সংগ্রহ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে আপনি কোন ধরনের কন্দ আনবেন। যে সমস্ত্ম কন্দ সাধারণত বিদেশের বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো থাকে চিলিং ছাড়া অর্থাৎ কৃত্রিম উপায়ে কোল্ড শক না দেয়া বাল্ব। কেউ কেউ শুনেছি প্রি-চিল্ড বাল্ব আনেন বিদেশ থেকে। সে ক্ষেত্রে বাল্বগুলো শুধু লাগিয়ে দিলেই হবে শীতের মাঝামাঝিতে। অবশ্য বাল্বকে মাটিতে লাগানোর আগ পর্যন্ত্ম ঠা-াতে রাখতে হবে।
তথ্যসুত্র, যায়যায় দিন, লেখক, আসমা অন্বেষা/ কৃপ্র/এম ইসলাম