কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
জাপানের কৃষি খাত দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। দেশটির কৃষি, বনায়ন ও মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে জাপানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিকাজে নিয়োজিত খানার সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৩০ হাজার। ১৯৬৫ সালেও দেশটিতে কৃষকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লাখ। ৫০ বছরের ব্যবধানে ২০১৫ সালে তা নেমে আসে ২০ লাখেরও নিচে।
দেশটির কৃষি খাতে এখন দুশ্চিন্তার আরেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকদের বয়সও। জাপানের কৃষি খাতে এ মুহূর্তে বয়স্ক ও বৃদ্ধ কৃষকের সংখ্যাই বেশি। তথ্যমতে, দেশটির প্রতি ১০ জন কৃষকের মধ্যে ছয়জনেরই বয়স এখন ৬৫ বছরের বেশি। অন্যদিকে তরুণদের মধ্যেও এখন কৃষিকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে গ্রহণে অনীহা দেখা যাচ্ছে।
তবে এর মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে কৃষিতে করপোরেট অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি ও ব্যাপক যন্ত্রায়ণ। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান দেশটির কৃষি ও কৃষিপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। বৃহদায়তনে ধান ও সবজি উৎপাদন এবং বিনিয়োগে নিয়োজিত রয়েছে ইয়োন সুপারমার্কেট চেইন, লসন, সেভেন অ্যান্ড আই হোল্ডিংস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান।
জাপানের কৃষি উৎপাদন খাতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগের দিক থেকে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হলো ফুজিত্সু। ২০১২ সালে ক্লাউডভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা সেবা আকিসাই চালুর মাধ্যমে এ খাতে পা রাখে ফুজিত্সু। বর্তমানে ইয়োনের ফার্মিং ডিভিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আকিসাইয়ের গ্রাহক। এছাড়া এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে এনইসি, হিটাচি, তোশিবা ও টয়োটার মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরও।
কানসাই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ‘প্যাসিভ হাউজ’ নামে প্যানাসনিক উদ্ভাবিত এক ধরনের গ্রিনহাউজ ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্যানাসনিকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিস্টেমস বিভাগ ও হাউজিং সিস্টেমস বিভাগ যৌথভাবে এ গ্রিনহাউজ উদ্ভাবন করেছে। এতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় আলো, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কোনো ব্যত্যয় ঘটলেই সেন্সরে তা ধরা পড়ে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা সমন্বয় হয়ে যায়।
কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কুবোতা সম্প্রতি এর প্রত্যক্ষ কৃষি কার্যক্রম আরো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। মূলত গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের খাতিরেই কৃষিকাজে সংশ্লিষ্টতা তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চারটি খামারে এ কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের মধ্যে এ ধরনের খামারের সংখ্যা ১৫তে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে কুবোতা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন কৃষিজমির পরিমাণ এক হাজার হেক্টর। এছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতিতে জিপিএস, সেন্সর ও ড্রোনের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিতে টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান এনটিটির সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে কুবোতা।
চলতি বছরের মধ্যেই স্বচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি বাজারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। মূলত যেসব তরুণ কৃষকের কৃষিকাজে অভিজ্ঞতা কম, তাদেরই পণ্যটির জন্য ‘টার্গেট মার্কেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিয়োটোভিত্তিক স্টার্টআপ মাইফার্মের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জাপানের জাতীয় পর্যায়ে কৃষিজমি বিক্রি বা ভাড়াসংক্রান্ত ডাটাবেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে আরেক টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান সফটব্যাংক।
শিনজো আবের সর্বশেষ সংস্কার এ ধরনের অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য কৃষিতে বিনিয়োগের পথ খুলে দিয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সব পর্যায়ের কৃষিতে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। ফলে দেশটির কৃষিতে সংকোচনের যে কালো ছায়া দেখা দিয়েছে, তা সাময়িক বলে মনে করছেন অনেকে।
এছাড়া জাপানে ভার্টিক্যাল ফার্মিং পদ্ধতিও ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সনাতন পদ্ধতিতে কৃষি জমির পাশাপাশি সারি বেঁধে বপন ও রোপণের মাধ্যমে শস্য ও সবজি ফলানো হয়। একে বলা হয় হরাইজন্টাল বা আনুভূমিক কৃষি পদ্ধতি। কিন্তু ভার্টিক্যাল ফার্মিং বা উল্লম্ব পদ্ধতিতে গ্রিনহাউজে একের পর এক তাকে শস্য বা সবজি ফলানো হয়। বিশেষ করে কিয়োটো ও টোকিও অঞ্চলে এ ধরনের চাষ পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
২০ বছর আগেই, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের দিকেই জাপানে চালু ছিল ২০ লাখেরও বেশি ট্রাক্টর। কম্বাইন হারভেস্টার চালু ছিল ১২ লাখেরও বেশি। জাপানে এসব যন্ত্রও এখন সেকেলে হয়ে পড়েছে। কৃষি ও কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিয়ে দেশটির কৃষিকে করে তোলা হয়েছে আধুনিক থেকে আধুনিকতর ও স্মার্ট। অন্যান্য শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতির কারণে জাপানের অর্থনীতিতে কৃষি এখন অত্যন্ত গৌণ একটি খাত, এ কথা সত্যি। কিন্তু এর পরও বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় একটি জায়গা হতে পারে জাপানের কৃষি খাত।
লেখক- সাইফ বাপ্পী, তথ্যসুত্র- দৈনিক যায়যায় দিন/ কৃপ্র/এম ইসলাম