কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ জাপান।ব্যাপক শিল্পায়নসহ নানাবিধ কারণে বর্তমানে এখানকার আবাদযোগ্য ভূমি মাত্র ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে আবার বড় একটি অংশ অবস্থিত পাহাড়ি খাড়া অঞ্চলে। সেখানে ধান বা অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতে হয় টেরেস ফার্মিং পদ্ধতিতে (পাহাড়ি জমি তাকের মতো স্তরে স্তরে কেটে সেখানে ফসল ফলানো পদ্ধতি)। তবে এখানকার আবহাওয়া বরাবরই ছিল চাষাবাদের অনুকূলে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, জমির বাড়তি উর্বরাশক্তি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আবাদযোগ্য স্বল্প জমিতেই ব্যাপক নিবিড় আকারে শস্য উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে জাপান।
আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ যত কমই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে জাপানের প্রতিটি অংশেই কৃষির উপস্থিতি দেখা যাবে। দেশটির কৃষিতে উত্তরাঞ্চলীয় দ্বীপ হোক্কাইডোর এক বিশেষ অবস্থান রয়েছে। জাপানের মোট কৃষি উৎপাদনের ১০ শতাংশই আসে হোক্কাইডো থেকে।
পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মতো জাপানের কৃষকদেরও একসময় প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর অনটনে দিন কাটাতে হয়েছে। বিশেষ করে সামন্ত যুগের শেষ পর্যায়ে এসে জাপানজুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, তার ঝড়ঝাপটা সেখানকার কৃষকদের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেও অভাব-অনটন আর দারিদ্র্য ছিল জাপানের কৃষকদের নিত্যসঙ্গী। সে সময়ও দেশটির কৃষিজমির পুরোটাই কুক্ষিগত ছিল গোটাকতক জমিদার ও সামন্ত ভূস্বামীর হাতে। এসব জমিদার ও সামন্ত ভূস্বামী রাজনৈতিকভাবে বেশ ক্ষমতাবান ছিল। এদের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার বিদ্রোহ করেছেন জাপানের কৃষকরা।
পরিস্থিতির বদল ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। মহাযুদ্ধে জাপান হেরে গেলেও দেশটির কৃষকদের জন্য তা শাপে বর হয়ে ওঠে। ১৯৪৬-৫২ সাল পর্যন্ত জাপানে দখলদারিত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কার্যক্রমে হাত দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ম্যাকআর্থার প্রশাসনের অধীনে সে সময় যে কয়টি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল কৃষি সংস্কার কর্মসূচি। জাপানের ক্ষুদ্র চাষীরা এ সংস্কার কর্মসূচির পূর্ণ সুফল ভোগ করেছেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের আগ্রাসী ভূমিকার পেছনে সেখানকার সামন্ত ও জমিদারদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর দেশটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসল মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী। সামন্ত ও জমিদারদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিল দখলদার ম্যাকআর্থার প্রশাসন। অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জাপান সরকারকে দিয়ে মোট কৃষিজমির দুই-তৃতীয়াংশ কম দামে কিনিয়ে নেয়া হলো। এরপর তা কম দামেই বিক্রি করে দেয়া হলো ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছে।
ম্যাকআর্থার প্রশাসনের এ সংস্কার কার্যক্রম জাপানের ক্ষুদ্র কৃষকদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিল। যদিও অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে শুরুর দিকে তাদের মুনাফা সীমিত হয়ে পড়েছিল। সংস্কারের আগে জাপানে মোট কৃষিজমির মাত্র ২৩ শতাংশের ওপর মালিকানা ছিল কৃষকের। সংস্কার কার্যক্রমের বদৌলতে ১৯৮০ সালের দিকে এসে দেখা গেল, দেশটির মোট কৃষিজমির পুরোটাই চলে গেছে কৃষকের মালিকানায়।
তবে এরও কিছু নেতিবাচক দিক ছিল। জমিদারি প্রথা যাতে কোনোভাবে ফিরে আসতে না পারে, সংস্কারের কালে সেজন্য কৃষিজমির মালিকানার ওপর সীমা আরোপ করা হয়েছিল। অর্থাৎ কারো পক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূমির অতিরিক্ত কৃষিজমির মালিক হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জাপানের কৃষিতে বেসরকারি করপোরেশনগুলোর বৃহদায়তন বিনিয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না। পাশাপাশি প্রতিযোগীর অভাবে জাপানের বৃহত্তম কৃষক সমিতি নোকিয়োর (ইংরেজি নাম জাপান এগ্রিকালচার বা জেএ) একচেটিয়া কর্তৃত্বে চলে যায় দেশটির কৃষি খাত। একই সঙ্গে শক্তিশালী লবি ও প্রেসার গ্রুপ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে এ কৃষক সমবায় প্রতিষ্ঠান।
পরিস্থিতিতে বদলের সূচনা দেখা দেয় ১৯৯৪ সালের দিকে। জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেডের (গ্যাট) অধীনে আয়োজিত উরুগুয়ে সম্মেলনের পর থেকেই জাপানের কৃষিতে আরেক দফা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে থাকে। এরপর ১৯৯৯ সালের মৌলিক কৃষি আইনের অধীনে যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোকে কৃষিতে বিনিয়োগের অধিকার দেয়া হয়। ওই আইনে বলা হয়, কৃষকের নেতৃত্বাধীন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলো। এরপর ২০০৯ সালের সংশোধিত কৃষিভূমি আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কৃষিজমি ভাড়া করে কৃষিকাজের (মালিকানায় নয়) অধিকার দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক কালে শিনজো আবের সরকার যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর জন্য কৃষিতে বিনিয়োগের সুযোগকে আরো শিথিল করে দিয়েছে। অকৃষি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কৃষিতে মূলধনি বিনিয়োগের সীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে তুলে নেয়া হয়েছে। কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক বোর্ডে কৃষকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে।
আবে সরকারের এ উদ্যোগের ফলাফল তাত্ক্ষণিকভাবেই হাতে পাওয়া যায়। শিনজো আবে ক্ষমতায় আসেন ২০১২ সালে। ২০১৪ সালের মধ্যে জাপানে কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ হাজারের বেশিতে। রাতারাতি দেশটিতে এ ধরনের কৃষি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০১৪ সালেই কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় এর পাঁচ বছর আগের অর্থাৎ ২০০৯ সালের তুলনায় সাড়ে ২৯ শতাংশ বেশিতে। পরবর্তী সময়ে দেশটির কৃষিতে পরিবর্তনের সবচেয়ে জোরালো পদধ্বনি শোনা যায় ২০১৬ সালের মে মাসে। সে সময় দেশটির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্পেশাল জোন আইনে পরিবর্তন আনা হয়। এর আওতায় বেসরকারি খাতের করপোরেশনগুলোকে ইয়াবু শহরাঞ্চলের কৃষিজমির শতভাগ মালিকানা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়।
লেখক- সাইফ বাপ্পী, তথ্যসুত্র- দৈনিক যায়যায় দিন/ কৃপ্র/এম ইসলাম