কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : জৈব সার, যেসব প্রাণীজ বা উদ্ভিজ পদার্থ পুষ্টি উপাদান ধারণ করে এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য জমিতে ব্যবহার করা হয় তাকে জৈব সার বলা হয়। আর প্রাণীজ সার বলতে গৃহপালীত পশুপাখির মলমূত্র পচিয়ে তৈরীকৃত বস্তুকে বুঝায়। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাণীজ জৈব সার হচ্ছে গোবর। কিন্ত আমাদের দেশে প্রাপ্ত গোবরের এক বিরাট অংশ জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গরুর নিচে বিছানো খড়, গৃহস্থালীর উচ্ছিষ্ট দ্রব্যাদি, বাড়ির ঝাড় দেয়া আবর্জনা প্রভৃতি গোবর মিশ্রিত করে পঁচানো সারকে খামারজাত সার বলে।
ফসলের পরিত্যক্ত অংশ যতটুকু সম্ভব জমিতে রেখে দিয়ে অথবা জমিতেই আবার ফিরিয়ে দিয়ে পরে চাষের সময় মাটির সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে দেয়া ভাল। যদিও দেশ জুড়ে জ্বালানী হিসাবে এগুলোর মূল্য রয়েছে। তথাপি মাটির উন্নয়ন কল্পে যতটুকু সম্ভব তা জমিতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিৎ। তাহলে ফসলের পরিত্যক্ত অংশে যে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে সেগুলো হারিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আবার মাটিতে ফিরে আসবে।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা তথা উর্বরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের দেশে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত খামারজাত সার ছিল প্রধান উৎস, যদিও এর আগে থেকেই রাসায়নিক সারের প্রচলন শুরু হয়েছিল। আজকাল চাষাবাদে জৈব ও রাসয়নিক উভয় প্রকার সারই ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্ত আদিকাল এমন এক সময় ছিল যখন মানুষের রাসায়নিক সার সম্পর্কে কোন জ্ঞানই ছিল না।
এমনকি জৈব সারের উপকারিতা সম্পর্কেও ধারণা করতে পারেনি। অবশ্য পশু পালন যুগে মানুষ লক্ষ্য করে দেখতে পায়, যেস্থানে পশু মল ত্যাগ করে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। তাছাড়া মানুষ আরও লক্ষ্য করল যে, গাছের লতাপাতা ঝরে মাটিতে মিশে পঁচে যাওয়ার পর সে স্থানে গাছের চারা তরতর করে বড় হয়ে উঠে। এভাবে পঁচা লতাপাতা, গোবর, আবর্জনা সার ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। চীনা কৃষি রেকর্ডে দেখা যায় যে, ৪ হাজার বছরেরও আগে মাটির উর্বরতা বজায় রাখার জন্য চীনারা গাছ ও জীব-জন্তুর অংশ বিশেষ ও মানুষের মলমূত্র জমিতে ব্যবহার করত।
ফসল উৎপাদনে মাটির স্বাস্থ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন হেঃ জমি আবাদযোগ্য। ফসলের নিবিড়তা ১৯১%। জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% এর কম। শুধুমাত্র জমিতে অজৈব সার ব্যবহার ও শস্য নিবিড়তার জন্য যাতে দিন দিন মাটির জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে। মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলী রক্ষায় মাটির জৈব পদার্থ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ইহা মাটির উন্নয়ন সাধনে অর্থাৎ মাটির গঠন, পানি ধারণ ক্ষমতা ও বায়ু চলাচলের উন্নয়ন সাধন করে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে। তাছাড়াও নাইট্রোজেন সরবরাহকারী ব্যাক্টেরিয়া (রাইজোবিয়াম, এ্যাজোটোব্যকটর), কেঁচো ইত্যাদি অনুজীবের খাদ্য ও শক্তি সরবরাহ করে।
একটি আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা আবশ্যক। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মাটিতে শতকরা ১.৫ ভাগের চেয়ে কম এবং কোন কোন মাটিতে শতকরা ১ ভাগের চেয়েও কম পরিমাণে জৈব পদার্থ রয়েছে-যা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধিষ্ণু জনগোষ্টির খাদ্য চাহিদা মেটাতে এক বিরাট হুমকি স্বরুপ। এর প্রধান কারণ হলো। উত্তরোত্তর ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল সম্প্রসারণ।
একই জমিতে একই বছরে একটির পর একটি ফসল হচ্ছে। একটি ফসল তোলার পর জমি থেকে প্রধানত ঘ, চ, ক ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে অপসারিত হচ্ছে। এর অর্থ বেশি করে ফসল উৎপাদনের সাথে সাথে মাটিতে খাদ্য উপাদানের মাত্রাও কমছে। কারণ উচ্চফলনশীল জাত জমি থেকে উচ্চমাত্রায় বিভিন্ন রকম উদ্ভিদ খাদ্য উপদান (সার) গ্রহণ করে থাকে। এতে মাটির খাদ্য ভান্ডার দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমাগত নিবিড় ও উচ্চফলনশীল জাতের চাষাবাদের ফলে ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ ব্যবহার করার পরও ইতোমধ্যে দস্তা ও বোরণ সারের অভাবে কোন কোন এলাকায় ফসলের ফলন দারুনভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম বা অন্য কোন খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়া বিচিত্র কিছু নয়। এভাবে নতুন নতুন উপাদানের ঘাটতি পুরণের জন্য এতগুলো সার ব্যবহার করা দারিদ্র কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না, অপরদিকে স্বচ্ছল, ধনী কৃষকের জন্যও এটি লাভজনক হবে না। এমতাবস্থায় জৈবসার প্রস্তুত ও ব্যবহারের প্রতি আরও বেশি যত্নবান হওয়া এখন সময়ের দাবী।
অতীতে ইচ্ছামত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। জমির অম্লতা এমনভাবে বেড়েছে যে, জমিতে ফসলই উৎপাদন একরকম কঠিন হয়ে পড়েছে। জমির সেই হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনতে জৈব সার ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। আবাদী জমির প্রাণ ফিরিয়ে আনতে এ সার উৎপাদন ও প্রয়োগে কৃষকদের পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষকে সচেষ্ট হতে হবে। এ সার মাটিকে যেমন সতেজ রাখতে পারে তেমনি ফিরিয়ে দিতে পারে আগের প্রাণ।
প্রয়োগ মাত্রা : জমির উর্বরতা ও ফসল ভেদে প্রতি শতাংশে ৬-১০ কেজি কুইক কম্পোষ্ট সার ব্যবহার করতে হবে। ফসলের জমি তৈরীর সময় প্রতি শতাংশে ৬ কেজি এবং কুশি পর্যায়ে সেচের আগে ২ কেজি করে উপরি প্রয়োগ করা যেতে পারে। সবজি ফসলের ক্ষেত্রে জমি তৈরীর সময় প্রতি শতাংশে ৬ কেজি এবং ৪ কেজি সার রিং বা নালা করে সবজি ক্ষেতে প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হয়।
ব্যবহারের উপকারিতাঃ সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে বাতাস চলাচল বৃদ্ধি পায়, অনুজীবের ক্রিয়া বাড়তে থাকে, ফসলের প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান সহজলভ্য হয়। ফলে আশানুরুপ ফলন পাওয়া যায় এবং গুনগত মান সম্পন্ন অর্গানিক (জৈব) পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয় যা বর্তমানে সারাবিশ্বে সমাদৃত। মাটি ফসল উৎপাদনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা পূরণ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্নতা অর্জনের প্রয়াস মাটিকে কেন্দ্র করেই। তাছাড়া শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যাপারেও মাটি থেকে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের অবদান অনস্বীকার্য। মাটিই হচ্ছে কৃষিজ উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম। এক কথায় কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবে মাটিই হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির কারণ। সুতরাং মাটির সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এর যথাযথ ব্যবহার ও গুনাগুণ সংরক্ষণের প্রতি আমাদের যত্নবান হওয়া উচিত।
কৃপ্র/ কে আহমেদ/এম ইসলাম