কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বরগুনার আমতলী উপজেলার বৈঠাকাটা গ্রামের জেলে আ. রাজ্জাক মিয়া (৫৮) জানান, ‘এক সময় আমাগো মতো গরীব মানুষগো রোদ-বর্ষার হাত থেইক্যা বাঁচাইতো গোল পাতা। বাপ-দাদা গো দেখছি গোলপাতা দিয়া ঘরের চাল ছাইতে (তৈরী করতে)। পয়সা খরচ কইরা গোলপাতা কেনা লাগত না। জংলা জায়গা, খালের পাড়ে সারি সারি গোলগাছ ছিল। গোলগাছের ফল ছিল পোলা-পাইনের মজার খাওন। আর গোলগাছের রসের গুড় ছিল খুবই স্বাদের’। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এহন আর সেই দিন নাই। গোলপাতা পাইতে হইলে সারা গেরামে ঘুইরা দুই-একখান ঝোপ হয়তো পাওয়া যাইতে পারে।’
উপকূলীয় এলাকা থেকে ক্রমেই গোলপাতা গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় চাষাবাদ, সংরক্ষণের অভাব সর্বোপরি জলবায়ুর প্রভাব গোলপাতা গাছের বিলুপ্তির কারণ বলে স্থানীয় লোকজন ও কৃষিবিদেরা জানিয়েছেন। বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক সময়ে বরগুনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলের লোকালয়ের খাল, বিল, নদী-নদীর তীর ও সাগর মোহনায় প্রচুর পরিমাণে গোলপাতা গাছ জন্মাতো।
২০ বছর আগেও শুধু মাত্র আমতলী উপজেলাতেই প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে গোলপাতা গাছ পাওয়া যেত। গোলপাতা গাছের পরিকল্পিত চাষাবাদ খুব একটা না থাকলেও প্রতিটি গ্রামের খালের দু’পাড়ে এবং নিচু ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই গোলপাতা গাছ জন্মাতো। গোলপাতা গাছের ঘন জংগল বাঘদাস, শিয়াল, বন্যমুরগীর অভয় আশ্রম ছিল বলে তালতলী উপজেলার ফকিরহাট গ্রামের আ. জলিল (৬০) আলাপকালে জানান। কিন্তু বর্তমানে সাগর তীরবর্তী জংগল সোনাকাটা, নিশানবাড়িয়া, হরিণঘাটা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় গোলপাতা নেই বললেই চলে। সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হেক্টর জমিতে গোলপাতা গাছের দেখা মেলে বলে সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে।
গাছের নাম ‘গোল’ হলেও এর পাতাগুলো দেখতে নারকেলগাছের পাতার মতো। সাধারণত একটি গোলপাতা গাছ লম্বায় ১০ থেকে ১৫ ফুট, কখনও ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
বরগুনা কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. বদরুল আলম জানান, লবনাক্ত পলিযুক্ত মাটিতে গোলপাতা গাছ ভাল জন্মায়। বিস্তীর্ণ এলাকাসহ খালের ধার ও নদীর চরাঞ্চল গোলপাতা গাছ চাষের উপযুক্ত স্থান।
গোলপাতা গাছের বীজ (গাবনা) মাটিতে পুঁতে রাখলেই চারা জন্মায়। একেকটি গাবনায় ১২৫ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত বীজ থাকে। গোলপাতা গাছ চাষে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হয় না। কীটনাশক বা রাসায়নিক সারের প্রযোজন হয় না, পরিচর্যারও দরকার পড়ে না গোলপাতা গাছ চাষে । বীজ সহজলভ্য ও চাষে ব্যয় কম হওয়ায় গোলপাতা চাষ খুবই লাভজনক জানান, কৃষি দপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান।
তালতলীর ছাতনপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদালয়ের শিক্ষিকা রাখাইন অং তেন জানান, ‘গোলপাতা গাছের কোন অংশই ফেলনা নয়। গোলপাতা ঘরের বেড়া ও চাল তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। পুরনো বা শুকনা পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোলগাছের ফল পুষ্টিকর খাদ্য। গোলের রস থেকে সুস্বাদু গুড় বা চিনি, মিছরি ও ওয়াইন তৈরী করা হয়।’ আমতলী সরকারী ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রধান, অধ্যক্ষ মজিবর রহমান বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকা হিসেবে আমতলীর বিস্তীর্ন এলাকায় এক সময় গোলপাতা গাছ চাষের অনুকূল পরিবেশ ছিল। বর্তমানে নদী ভাঙ্গন, মাটি ও পানিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধির মতো জলবায়ু’র পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবে গোলপাতা গাছ জন্মানোর হার কমিয়ে দিয়েছে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগে নেয়া হলে গোলপাতা গাছ চাষ পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।’
সুত্রঃ বাসস / কৃপ্র/এম ইসলাম