চাষা আলামীন জুয়েল: ইসলামে কৃষি কাজের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন রাসূল (স.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি বৃক্ষরোপণ করে কিংবা খাদ্যশস্যের বীজ বপন করে, অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু কিছু অংশ খায় তবে তার জন্য এই কাজ (বীজ বপন) সাদাকাহ হিসেবে বিবেচিত হবে’ (বোখারী, মুসলিম)।
এই হাদিস হতে আমরা বিভিন্ন ধারণা পাই-
প্রথমত, কৃষিকাজ করা কিংবা গাছ লাগানো জীবিকার একটি স্বাভাবিক মাধ্যম। যার উপকারিতা ও কল্যাণ মানুষ এবং পশুপাখি তথা সব জীবের ওপর সমভাবে পৌঁছে থাকে।
দ্বিতীয়ত, কৃষিক্ষেত্র থেকে মানুষ বা পশু পাখি যারই উপকার ও কল্যাণ সাধিত হোক তার বিনিময়ে অবশ্যই সে (কৃষিক্ষেত্র তৈরিকারী) নেকি পেতে থাকে।
তৃতীয়ত, কৃষির উন্নতি বিধান করা অবশ্যই জরুরি। কেননা কৃষি ব্যতিরেকে মানুষ কিংবা পশুপাখি সবার জীবন ও জীবিকাই সংকীর্ণ ও রুদ্ধ হয়ে থাকে।
মহানবী (সা.) কোনো আবাদযোগ্য ভূমি কৃষিকাজ ব্যতিরেকে পতিত কিংবা অনাবাদি না রাখার জন্য দৃঢ় ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো পতিত ভূমি আবাদ করবে, সে সেই জমির মালিক হবে। এ ঘোষণার প্রতিধ্বনি আরেকটি হাদিস আছে, ‘যে ব্যক্তি এমন অনাবাদি জমি আবাদ করে যা অন্যের নয়, সে ওই জমির মালিকানার ব্যাপারে অর্ধেক দাবিদার’ (বোখারী শরীফ)।
হজরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল পাক (সা.) বলেন, ‘যার জমি আছে সে যেন নিজেই তা চাষ করে। যদি নিজে চাষ না করতে পারে তবে (পতিত না রেখে) কোনো প্রতিদান ছাড়াই যেন অপর ভাইকে তা দান করে’ (মুসলিম শরিফ)।
কৃষি উন্নয়নমূলক সংস্কারে হজরত ওমর (রা.) বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি সমগ্র বিজিত এলাকায় নদীনালায় সংস্কার, বাঁধ নির্মাণ, পুকুর খনন, জলাধার তৈরি ইত্যাদি কাজ করেছেন। স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠাসহ শুধু মিসরেই প্রায় এক লাখ বিশ হাজার শ্রমিক বার্ষিক ভিত্তিতে এই কৃষি সংস্কার উন্নয়নমূলক কাজে নিযুক্ত ছিল।
কোরআন মজিদের বহু স্থানে বৃক্ষ, তরুলতা, বাগান ও উদ্যানের কথা উল্লেখ করে এর নানাবিধ উপকারের কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘যিনি নানা প্রকারের লতা বিশিষ্ট ও কাণ্ডের উপর দণ্ডায়মান বিশিষ্ট বাগান, খেজুর গাছ ও নানা প্রকার খাদ্যের উদ্ভিদ, ভেষজ, ফল-ফলাদি, যাইতুন ও আনারের গাছ সৃষ্টি করেছেন, যা বাহ্যিক রূপে সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু স্বাদে সাদৃশ্যহীন’ (সূরা আনআম: আয়াত-১৪১)।
কোরআন মজিদে বলা আছে, ‘আমি জলধর মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি। যাতে তা দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও পাতাঘন উদ্যানরাজি’ (সূরা আন নাবা : আয়াত ১৪-১৬)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন এবং পশুপাখিই এই উৎস। নবীজী আরও বলেছেন, তোমরা ভেড়া পালন কর। কারণ এরা সকাল সন্ধ্যায় তোমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। তিনি আরও বলেন, দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত সব নবীই মেষ চরিয়েছেন। নবীজী নিজেও মেষ পালন করেছেন। সূরা বাকারা ও সূরা আনয়াম-এই দুটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে পশুর নামানুসারে। বাকারা শব্দের অর্থ গাভী এবং আনয়াম শব্দের অর্থ পশুসম্পদ।
জলরাশিকে মাছচাষের উপযোগী করে অসংখ্য প্রজাতির বিচিত্র মাছ আল্লাহ তৈরি করেছেন যাতে মানুষ সাগর-মহাসাগর, নদনদী, পুকুর, হাওর-বাঁওড়, হ্রদ ইত্যাদি থেকে মাছ আহরণ করতে পারে এবং প্রয়োজনমতো পুকুর, ডোবা ও খাল বিলে মাছ চাষ করে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বর্ণিত আছে, ‘দুইটি দরিয়া এক রকম নয়, একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয় এবং অপরটির পানি লবণাক্ত ও বিস্বাদ। তোমরা প্রত্যেকটি থেকে মাছ ধরে এর তাজা গোশত খাও’ (সূরা ফাতির : আয়াত ১২)।
সুস্বাদু ফল ফলাদি-জ্বালানি ও গৃহ সামগ্রী তৈরিতে গাছের তথা বনায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশের ভারসাম্য বজায়, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার অন্যতম হাতিয়ার বনায়ন। মহানবী (সা.) বৃক্ষরোপণের জন্য সাহাবিগণকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজেও বাগানে কাজ করেছেন। তিনি বৃক্ষ রোপণ ও ফসল বপনকে সদকায়ে জারিয়ার কাজ বলেছেন। ‘কোনো মুসলমান বৃক্ষ রোপণ অথবা শস্য বপন করলে যদি তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু কিছু আহার করে তবে তা তার জন্য সাদাকাস্বরূপ হবে’ (বোখারী, মুসলিম)।
বৃক্ষরাজি, তরু লতা ও উদ্ভিদসমূহ আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং জমিনকে বিদীর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য এগুলো সৃষ্টি করেছেন। খাবার, ফলমূল, পশুর খাদ্য ইত্যাদি আমরা বিভিন্ন গাছ-গাছালি থেকে পেয়ে থাকি। এ সম্পর্কে কোরআন মজিদে উল্লেখিত আছে ‘তিনি আমাদের জন্য বৃষ্টির দ্বারা জন্মান শস্য, জয়তুন খেজুর বৃক্ষ এবং সর্ব প্রকার ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা নাহল : আয়াত-১১)।
প্রতিপালন ও সংরক্ষণঃ
কৃষি কাজের ওপর গুরুত্বের পাশাপাশি উপকরণসমূহের সদ্ব্যবহার ও উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজিদে বর্ণিত আছে- ‘তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবনধারণের উপকরণ) স্মরণ কর। আর জগতে বিনষ্টকারী ও বিপর্যয়কারী হয়ো না’ (সূরা আল আরাফ : আয়াত-৭৪)। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘নবী করিম (স.) সম্পদ নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন’ বোখারী ও মুসলিম)।
নবীজী বৃক্ষ নিধন এমনকি অকারণে বৃক্ষের পাতা ছিঁড়তেও নিষেধ করেছেন। শস্য ব্যবহারের উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রহ করা বা বিক্রয় করা উচিত নয়। এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত ‘রাসূলুল্লাহ (স.) ফলে পরিপক্বতা দেখা না দেওয়া পর্যন্ত বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন’ (বোখারি, মুসলিম)। জগতে সব প্রাণীই আল্লাহর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
হাদিস শরিফে আছে- ‘সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারে অন্তর্ভুক্ত। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টি (প্রাণী ও উদ্ভিদ সব জীব)- এর প্রতি উত্তম আচরণ করবে সে তার নিকট অধিক প্রিয়্, (বায়হাক্বী)। উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণের ধারণা কোরআন মজিদের সূরা ইউসুফে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু বছর আগে নবী হজরত ইউসুফ (আ.) মিসরের দায়িত্বকালে শস্য সংরক্ষণ রীতি অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে পর পর সাত বছরের দুর্ভিক্ষের করালগ্রাস থেকে তার দেশবাসী মুক্তি পেয়েছিল।
আল্লাহ পাক কোরআন মজিদে এ ব্যবস্থাপনার বর্ণনা করেছেন ‘তিনি (ইউসুফ আ.) বললেন, তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যে ফসল পাওয়া যাবে তার মধ্য থেকে সামান্য পরিমাণ খাবে, অবশিষ্ট শস্য শিষ সমেত রেখে দেবে। আর এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। তোমরা এ দিনের জন্য যা সঞ্চিত রেখেছিলে তা খেয়ে যাবে, কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত যা তোমরা তুলে রাখবে (সূরা ইউসুফ : ৪৭-৪৮)।
ইসলামের দৃষ্টিতে সংরক্ষণের আরেকটি দিক হলো অপচয় না করা। অপচয় উৎপাদনের সুফল নস্যাৎ করে এবং আর্থিক সচ্ছলতা ধ্বংস করে। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে- ‘তোমরা অপচয় করো না, নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই’ (সূরা বণী ইসরাইল : আয়াত-২৬-২৭)।
অতঃপর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আল্লাহ্ কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের সম্পদ বাড়িয়ে দেব’ (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত-৭)। আর শুকরিয়া জানানোও একটি নৈতিক দায়িত্ব। ভাবতেও ভালোলাগে কৃষিকাজ করা সুন্নত।
কবি নজরুলের অমর বাণীকে স্মরণ করছি—–
‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল
মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানী’।
( তথ্য– সংকলিত )
কৃপ্র/ এম ইসলাম