‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’
ড. মো. হুমায়ুন কবীর: পর্যটন একটি শিল্প। সেইসাথে এটি একটি সংস্কৃতি, একটি কলা, একটি বিজ্ঞান ইত্যাদি সব বিভাগেই একে ফেলা যেতে পারে। পর্যটন হলো মানুষের মনে ভ্রমণ করার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে। সেজন্য বলা চলে পর্যটন একটি আদিম পেশাও। কারণ দেখা গেছে পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই বিভিন্ন পরিব্রাজকের পরিভ্রমণের মাধ্যমে আবিস্কৃত হয়েছে। দুয়েকটি উদাহরণ দিলেই তা একটু পরিষ্কার হতে পারে।
পৃথিবী যে গোল এবং তা পুরোপুরি গোলও নয় সেটি উত্ত-দক্ষিণে একটু চ্যাপ্টা। এগুলো প্রমাণ করেছেন পর্যটক পরিব্রাজকেরা। তারা জাহাজ চালিয়ে দেশান্তরে ছুটে চলেছেন। সেই জাহাজ চালাতে চালাতেই তারা এসব আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় কলম্বাসও সাগর-মহাসাগরে জাহাজ চালাতে গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। কাজেই দেখা যায় পর্যটনের মাধ্যমে যে শুধু মনের খোরাক সৃষ্টি হয় তাই নয়, এর মাধ্যমে অনেক কিছু সৃষ্টি হয়েছে, যার দ্বারা সবসময়ই আমরা সভ্যতার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হচ্ছি। আর সেই পর্যটনকে গুরুত্ব দেওয়ার অংশ হিসেবে বিশ্ব সংস্থা হিসেবে পরিচিত জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮০ সালে পর্যটনের জন্য একটি আলাদা সংগঠন ‘জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ((United Nations World Tourism Organization-UNWTO)’ গঠন করা হয়। তার আগে ১৯৭০ সালে প্রথমে এটি সৃষ্টির জন্য একটি নীতিমালা অভিযোজন করে নেওয়া হয়। যে তারিখে জাতিসংঘ কর্তৃক সেটি গৃহীত হয়েছিল সেই ২৭ সেপ্টেম্বরকেই বিশ্ব পর্যটন দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। তখন থেকে এ সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বে জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্যরাষ্ট্রে এ দিনটিকে ঘিরে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
প্রতিবছরই পর্যটন দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য বিষয়কে থিম ধওে তদানুয়ায়ী যুৎসই একটি শ্লোগানকে ধারণ করে তা পালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘সবার জন্য পর্যটন, সর্বজনীন পর্যটন অভিগম্যতা’ ইংরেজিতে যা Tourism for all: promoting universal accessibility’’। এবারো দেশ বিদেশে সদস্য রাষ্্রটসমূহে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য বিশেষ বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
আগেই বলেছি পর্যটন একটি সম্ভাবনাময় খাত। সেই অনাদি অনন্তকাল ধরেই মানুষ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। সেই ঘুরে বেড়ানোর নামই আসলে পর্যটন। মানুষ হলো সভ্যতার সবচেয়ে বড় যন্ত্র দানব। মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে মানুষ পাওে না এমন কোন কাজ নেই। সেজন্য মানুষ সর্বদাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কবিতার ছন্দে রয়েছে, ‘বিশ্রাম আর কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা’।
এ পর্যটনের সাথে মেন্টাল রিক্রেয়েশন, কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লাভ-লোকসান ইত্যাদি প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ আছে যাদের পর্যটনই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, নেপাল, ভুটান, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন, ইটালি, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড তাদের মধ্যে অন্যতম। এ বহরে এখন বাংলাদেশের নামও যুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার জন্য মানুষ পর্যটনে বেরিয়ে পড়ে।
আমাদের পাশ্ববর্তী ভারত ভ্রমণ করলে সারাবিশ্ব ভ্রমণ করার সামিল বলে মনে করেন অনেক অভিজ্ঞ পর্যটকগণ। কারণ ভারতের আগ্রার তাজমহল, পবিত্রভূমি হিসেবেখ্যাত আজমীর শরীফ, পাহাড়ী দার্জিলিং, বরফাবৃত সিমলা, মানালি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মনিপুর, জয়পুর , ভূস্বর্গ কাশ্মীর, বেনারস ইত্যাদি স্থান দেখলে মন জুড়িয়ে যায়, যাতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও রয়েছে। আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র বন্দরের লুটাস টেম্পল ইত্যাদি বিশ্বময় অনেক কিছুই দেখার রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে এত বেশি পমিাণে দর্শণীয় স্থান ও বিষয় রয়েছে যার তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এ পর্যটনকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রতিবছর একটি থিম ও শ্লোগানকে সামনে ধরে দিবসটি পালন করার মূল উদ্দেশ্যই হলো বিশ্বের মানুষের কাছে একে জনপ্রিয় করা এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। সেজন্য এতে মানুষে মানুষে দেশে দেশে ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক , রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক তৈরী হতে পারে। আর বাংলাদেশও সবসময় পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্ত এ খাতে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও কিছু সমস্যার কারণে তা ব্যাপকতা লাভ করতে পারছেনা।
বাংলাদেশে পর্যটনকে আকৃষ্ট করার জন্য সরকার কর্তৃক ২০১৬ সালকে পটর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে ১০ লক্ষ পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং যাতায়াত ও থাকা খাওয়ার জন্য ভালোব্যবস্থা এখনো সৃষ্টি না হওয়ায় এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া সাম্প্রতিক কিছু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে বিদেশি পর্যটকগণ নিরোৎসাহিত হওয়ায় এ লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তারপরও পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান।
সেজন্য দেখা গেছে ঈদ, পূজা-পার্বণ, পহেলা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, ইংরেজি নববর্ষ বরণ বা থার্টিফার্স্ট নাইট পালনের জন্য বাংলাদেশের কক্সবাজার, পতেঙ্গা, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটিসহ সারাদেশের পর্যটন স্পটসমূহ তাদের পসরা সাজিয়ে পর্যটক বরণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসটি পালনের জন্য আমার নিজের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিটিবি থেকে একটি মেসেজ এসেছে, সকাল সাড়ে আটটায় কেন্দ্রীয়ভাবে তা পালনের জন্য ঢাকাস্থ মৎস্য ভবনের সামনে থেকে অয়োজিত একটি র্যালিতে অংশ নেওয়ার জন্য। সেটা পালিত হলে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরীকে কিছুট হলেও কাজে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর এখানেই হলো বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনের সার্থকতা।
লেখক: ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
কৃপ্র/ এম ইসলাম