চাষা আলামীন জুয়েলঃ মাটির স্বাস্থ্য বলতে কি বোঝায়?
কথায় আছে-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। মানুষকে প্রতিদিন বিভিন্ন কাজ করতে হলে শারীরিক ভাবে সুস্থ্য অর্থাৎ নিরোগ থাকতে হয়। তেমনিভাবে গাছ ও যেহেতু প্রধানত মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে, তাই মাটির স্বাস্থ্যও ভাল রাখতে হয়। এক কথায় বলতে গেলে মাটির স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় মাটির বুনট, পানি ধারণ ক্ষমতা, জৈব পদার্থের পরিমান, মাটির উর্বরতা অর্থাৎ মাটিতে পুষ্টি উপাদান কেমন আছে ইত্যাদি বিষয়গুলো।
মাটি পরীক্ষা কেন করতে হয়?
মানুষের শরীরের বৃদ্ধির জন্য যেমন ভিটামিন ও খাবারের প্রয়োজন, তেমনি গাছের বৃদ্ধির জন্যও খাদ্যের দরকার। গাছের খাদ্য হচ্ছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সালফার, বোরন, জিংক ইত্যাদি । গাছ তার খাদ্য মাটি থেকে শিকড়ের সাহায্যে গ্রহণ করে বা খায়। মাটিতে যদি পুষ্টি উপাদান কম থাকে তাহলে গাছের বৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটে ও ফলন কম হয়। গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মাটিতে আছে কিনা তা জানতে হলে আগে জানতে হবে মাটিতে কি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান আছে। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে মাটিতে উপস্থিত পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ জানা যায়।
কৃষক ভাইয়েরা সাধারণত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে জমিতে সার দিয়ে থাকেন৷ ফলে কোন সার বেশী, কোন সার কম দিয়ে থাকেন। যেমন আমরা সার বলতে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি সারকেই বুঝে থাকি ও ফসল চাষের ক্ষেত্রে এই তিনটি সারই বেশী ব্যবহার করে থাকি। ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যাবহারের ফলে জমির উবর্রতা ও ফসল উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর সঠিক নির্দেশনা মতো সার প্রয়োগ করলে সারের অপচয় কম হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়। সারের অপচয় কমে যায় বিধায় ব্যয় কম হয় এবং পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগের ফলে রোগ – পোকামাকড়ের আক্রমণ কমে যায় ।ফলে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
অতিরিক্ত সার ব্যবহার বা প্রয়োগ করলে তা পানির সাথে মিশে পুকুর, ডোবা, নালায় পরে ও কিছু বিষাক্ত পদার্থ হিসেবে মাটির সাথে মিশে যায়। যা থেকে মাটি ও পানি দূষীত হয়। মাটি পরীক্ষা করে পরিমিত মাত্রায় সার প্রয়োগের ফলে একদিকে যেমন মাটি-পানি দূষন মুক্ত থাকে, অন্যদিকে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে, মাটি উর্বর হয়, মাটির পরিবেশ ফসল আবাদের উপযোগী থাকে।
মাটির নমুনা সংগ্রহের নিয়ম কি?
মাটির নমুনা বলতে বোঝায় কোন জমি থেকে সংগৃহীত কিছু মাটি, যা পরীক্ষা করলে ঐ জমির সমস্ত মাটির গুণাগুণ কেমন আছে তা বোঝা যায়। মাটির নমুনা সংগ্রহের কিছু নিয়ম আছে সেগুলো হলো-
১. মাটির নমুনা সংগ্রহের জন্য অগার যন্ত্র বা নিড়ানী বা কোদাল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. জমির আইল হতে ২-২.৫ মিটার ভিতরের অংশের জমি হতে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে ৷ নির্বাচিত অংশের ১০-১২টি স্থান হতে এক কোদাল করে মোট ১০-১২ টি উপ-নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
৩. খামার জাত ফসলের জমির ০-১৫ সেন্টিমিটার (০-৬ ইঞ্চি) গভীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। আঁখ, ফলজ বৃক্ষ ও বনজ বৃক্ষের জমির জন্য ০-৩০ সেন্টিমিটার (০-১২ ইঞ্চি) গভীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
৪. কোদালের সাহায্যে লাঙ্গল স্তর হতে “ঠ” আকারের মাটির টুকরো সংগ্রহ করতে হবে। মাটির টুকরোর উপরিতল ৭-৮ সেন্টিমিটার পুরু হতে হবে।
৫. জমি হতে সংগ্রহীত উপ-নমুনাগুলো একত্রে মিশাতে এবং গুড়া করতে হবে। নমুনা সংগ্রহের পর তা থেকে আগাছা, গাছের শিকড় ও অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে।
৬. মিশ্রিত মাটি পলিথিন সীটে রেখে সমান চার ভাগে ভাগ করতে হবে। এই চার ভাগ হতে যেকোন দুই কোনার দুইভাগ নিয়ে আবার মিশাতে হবে। বাকি দুইভাগ মাটি ফেলে দিতে হবে। মিশ্রিত মাটি আবারো সমান চার ভাগে ভাগ করতে হবে ৷ এভাবে একই নিয়মে ততক্ষণ ভাগ করতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ৪০০-৫০০ গ্রাম মাটি পাওয়া যায়।
৭. এর পর নমুনাগুলো পরিষ্কার ছায়াযুক্ত স্থানে পলিথিন বা খবরের কাগজের উপর সুন্দরভাবে ছড়িয়ে বাতসে শুকাতে হবে। আগুনে বা রোদে মাটি শুকানো ঠিক না। শুকানোর পর সংগ্রহীত নমুনা মাটি পলিথিন সীটে রেখে মুগুর বা কাঠের হাতুরি দ্বারা মাটির ঢেলা ভেঙ্গে গুড়া করতে হবে।
৮.এভাবে প্রস্তুতকৃত ৫০০ গ্রাম মাটি পলি ব্যাগে রেখে শক্ত করে ব্যাগের মুখ বেধে দিতে হবে। এরপর মাটি পরীক্ষার জন্য উপজেলা কৃষি অফিস বা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এ নিয়ে যেতে হবে।
মাটি পরীক্ষার জন্য কোথায় যোগাযোগ করতে হবে?
মাটি পরীক্ষার জন্য কাছের উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সেখানে বিনামূল্যে মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়াও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এর বিভিন্ন গবেষণাগারেও যোগাযোগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট থেকে ভ্রাম্যমান মাটি পরীক্ষার গাড়ি বিভিন্ন উপজেলাতে অবস্থান করে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সময়সূচী আগে থেকে জেনে নিয়ে সেখানে নামমাত্র মূল্যে মাটির বিস্তারিত গুনাগুণ পরীক্ষা করা যায়। আরেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ । তাহলো প্রতিটি পরীক্ষার পরই কিন্তু সার সুপারিশপত্র বা সারের প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়। যা মেনে চললে কৃষক ভাইয়েরা নিশ্চিতভাবে লাভবান হতে পারেন।
তথ্য: ( সংগৃহীত ও সংকলি্ক। সকল চাষি ভাই-বোনদের জন্য শুভ কামনায়—– চাষা আলামীন জুয়েল।
কৃপ্র/ এম ইসলাম