কৃষিবিদ মোসলেহ উদ্দিন সেলিম: আমরা বিষাক্ত এক নগরের বাসিন্দা । নগর জীবনে বর্তমানে সবুজের দেখা পাওয়া বেশ দুষ্কর । দিন দিন কমে যাচ্ছে সবুজের ছোঁয়া । কিছুদিন আগেও দু/চারটা গাছ নেই এমন কোন বাড়ি ছিল না । সময় দ্রুতই পাল্টাচ্ছে । এখন বড় বড় অট্টিালিকার কবলে দেশ ।আবার শহরের অধিকাংশ ছাদ্গুলো এখনও ফাঁকা পরে আছে । অথচ এই ছাদগুলোকে অনায়াসেই সবুজ করা যায় ।।আর তাতে নগরীর প্রতিটি বাড়ির ছাদ হয়ে উঠতে পারে একখন্ড সবুজ বাগান।শহরের পরিবেশ রক্ষায় এ ধরণের ছাদ ও ব্যালকনি বাগানের ভূমিকা অপরিসীম।বিষমুক্ত টাটকা ফল-মূল, শাক-সবজির স্বাদ আস্বাদনের জন্য ছাদে বাগানের কোন বিকল্প নেই । গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছ-পালার মাধ্যমে সবুজায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে রুফ গার্ডেন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ।অবকাঠামো তৈরীতে যে পরিমান জমি নষ্ট হচ্ছে তা কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যাবে রুফ গার্ডেনিং এর মাধ্যমে ।এ ছাড়াও রুফ গার্ডেনিং এর আরও অনেক ইতিবাচক দিক আছে ।কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে শারিরীক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, অর্থের সাশ্রয় এমনকি বেকারত্ব ঘোচাতেও রুফ গার্ডেন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে ।
প্রকৃতির সাথে বসবাসের উপায় হিসেবে আজকাল শহরের অনেক বাসিন্দারাই ঝুঁকছেন ছাদ অথবা ব্যালকনি বাগানের দিকে। কিন্তু তা এখনও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয় । ছাদ বাগান শুরু করার পর সঠিক তথ্যের অভাবে অল্পদিনেই অনেকেই বাগান করা ছেড়ে দিচ্ছেন বা বাগান করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন । কিন্তু নিয়ম জেনে কাজ শুরু করলে এ অবস্থা হতো না । সঠিক পরিকল্পনা থাকলে ছাদের বাগান থেকে নিজের পারিবারিক ফল-মূল, শাক-সবজির ছাহিদা মিটিয়ে আয় করাও সম্ভব।স্যাটেলাইট যুগে শিশুদের মানসিক বিকাশেও এধরণের বাগান গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে । যে কেউ দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে সামান্য সময় ব্যয় করেই করতে পারেন একটি সুন্দর সবুজ ছাদ বাগান । পরিকল্পিত ছাদ বাগান সৃজনে সহয়তার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে আমার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আধুনিক কৃষিমনা। এই সংগঠনের সরাসরি পরামর্শ ও সহযোগীতায় ইতিমধ্যে ৩৭ টি দৃষ্টিনন্দন ছাদবাগান গড়ে উঠছে কুমিল্লা মহানগরীতে যার জন্য সর্বাত্মক সহযোগীতা করছেন উপ পরিচালক ডিএই কুমিল্লা কৃষিবিদ মোঃআসাদুল্লাহ মহোদয়।
বাড়ির ছাদে বাগান করতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো ছাদ নষ্ট হওয়া । ছাদ সুরক্ষার জন্য প্রযোজনীয় ব্যবস্থা নিয়েই ছাদ বাগান করতে হবে । ছাদে স্থায়ী বাগান করতে হলে প্রথমেই দুই ইঞ্চি পুরু করে অতিরিক্ত একটি ঢালাই দিয়ে নেট ফিনিশিং দিতে হবে । যদি উক্ত ছাদের উপর ভবিষ্যতে আরো ছাদ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে স্থায়ী বেড না করে টব বা ড্রামে বাগান করাই উত্তম । টব/ড্রাম যে কোন সময় স্থান পরিবরর্তন করার ফলে ছাদ পরিস্কার থাকে । আর তাতে ছাদ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে । টব বা ড্রামটিকে ছাদের ফ্লোর থেকে সামান্য উপরে বসালে পানি জমে থাকে না, ড্রামের নিচে পরিস্কার করতেও সুবিধা হয় । ছাদ থাকে সবসময় ঝকঝকে । স্থায়ী বেড পদ্ধতিতে গাছ একটু বেশী বড় হয়ে যায় । দেখতে খুব একটা ভাল লাগে না । একবার তৈরী করার পর দেখতে সুন্দর না লাগলেও আর কিছু করার থাকে না । নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে ছোট ছোট টব দিয়েই শুরু করা ভাল ।
ছোট টবের জন্য উপযোগী ফল গাছ যেমন – লেবু , ডালিম , কামরাংগা , করমচা , সফেদা , মিশরীয় ডুমুর , চেরী ফল , কমলা, বারমাসী আমড়া, আতা ইত্যাদি । যা খুব সহজেই ছাদে এদের চাষ সম্ভব । কাজেই ছাদে বাগান শুরু করার ক্ষেত্রে প্রথমে এই সব ফল গাছ দিয়েই শুরিু করা উচিৎ । মাঝারী আকারের উপযোগী গাছ যেমন – থাই মিষ্টি তেতুল , পেয়ারা , জামরুল , আংগুর , বাতাবী লেবু , আম , অরবরই , আমলকি , মালটা ইত্যাদি । আর বড় টবের উপযোগী গাছ যেমন- যে কোন কূল জাতীয় গাছ , জলপাই , কতবেল , বেল , বারমাসী কাঁঠাল , জাম , পেঁপেঁ , কলা ইত্যাদি ।নতুন রুফ গাডেনার্সদের প্রতি আমার বিশেষ পরামর্শ থাকবে আজে বাজে গাছ দিয়ে ছাদ না ভরে ভাল জাতের অল্প সংখ্যক গাছ লাগান ।
নার্সারীম্যানদের কথা মোতাবেক রাসায়নিক সার কিটনাশকের যথেচ্ছ ব্যববহার করবেন না । ছাদে অবশ্যই কলমের চারা ব্যবহার করুন । টবের গাছে প্রতিবছর ফল পেতে হলে বছরে একবার টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করতে হবে । যদি গাছটি ছোট টবে হয় তাহলে বড় টবে নিতে হবে । আর যদি টবের সাইজ ১৬ ইঞ্চি থেকে ২০ ইঞ্চি বা তার চেয়ে বড় কোন টব বা হাফ ড্রাম হয় তবে টব পরিবর্তন করতে হবে না ।শুধু টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করলেই চলবে এবং এটি ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবছর করতে হবে । যদি নিয়ম মাফিক কাজটি করা যায় তাহলে প্রতিবছর উক্ত গাছ থেকে ফল পাওয়া যাবে । ছাদে বাগানের ক্ষেত্রে একটা অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায় তাহল প্রথম বছর ফল ভালই ধরেছিল কিন্তু এখন আর ধরে না ।এর কারণ একটাই । টব বা ড্রামের মাটি পরিবর্তন না করা । কষ্ট করে প্রতিবছর একবার সামান্য মাটি পরিবর্তন করার কারণে প্রচুর পরিমানে গাছে ফল ধরবে ।
ছাদে খুব অল্প পরিশ্রমে যে সব শাক-সবজির চাষ করা যায় তা হলো- করলা, টমেটো,করলা, ঢেঁড়শ, চিচিংগা, ঝিংগা, পুঁই শাক, চালকুমড়া, কলমীশাক, মুলা, কাচামরিচ, ক্যাপসিকাম, ধনেপাতা, কচু, ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রুকলি, গাজর, ডাটা, লাল শাক ইত্যাদি । এইসব শাক-সবজির জন্য তেমন কোন পরিচর্যার প্রয়োজন পরে না । তবে নিয়মিত এবং পরিমিত পরিমানে পানি দিতে হবে ।বীজ লাগানোর আগে মাটি প্রসেসের সময় জৈব সার প্রয়োগ করতে হয় । পরবর্তীতে মাঝে মাঝে মাটি কিছুটা খুচিয়ে সামান্য খৈল পঁচা পানি দিতে হবে ।
একটু ছায়াযুক্ত স্থানে যে সব গাছ লাগানো যায় তা হলো বিভিন্ন ধরণের পাতাবাহার, মানি প্ল্যান্ট, ফাইলো ডেনড্রন, ড্রেসিনা, ক্রোটন, বাহারি কচু, পাম, অ্যানথুরিয়াম, আইভি লতা, ডাইফেনবেকিয়া, ম্যারান্টা, মনস্টেরা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ছাদে গাছ লাগানোর পদ্ধতিঃ
ক) টব বা ড্রাম এর তলদেশে অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের জন্য ৩-৫ টি ছিদ্র করতে হবে।
খ) ছিদ্র গুলোর উপর তয়েক টুকরা চারা বা সুরকি দিতে হবে।
গ) ২ ভাগ বেলে দোঁআশ মাটি ১ ভাগ গোবর টবের সাইজ অনুযায়ী ৩০-৫০ গ্রাম টি,এস,পি ও পটাশ সার ভাল করে মিশিয়ে টব বা ড্রামটি ভরে দিতে হবে ।
ঘ) কমপক্ষে ১৫ দিন পর টব বা ড্রামের মাঝখানে চারা রোপন করতে হবে ।
ঙ) একটি খুটি গেঁথে দিতে হবে এবং গাছটিকে খুটির সংগে বেধে দিতে হবে ।
চ) চারা গাছ রোপনের পর অল্প পরিমানে পানি দিতে হবে ।
ছ) গাছ লাগানোর ২-৩ মাস পর থেকে পানির সাথে মিশিয়ে হালকা ভাবে সরিষার খৈল পঁচা পানি দিতে হবে ।
জ) চারা গাছ লাগানোর পর যেন তাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
পরিশেষে সকলের প্রতি আমার আহবান কাল নয়, আজ থেকেই ব্যালকনি কিংবা ছাদটাকে সবুজে সবুজে ভরে দেবার কাজটা শুরু করি । বসবাসের উপযোগী করে তুলি আমাদের বাসস্থান । আমরাই পারি নগরটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে। প্রয়োজন শুধু আমাদের একটু সদিচ্ছা আর মানসিকতার ।
কৃপ্র/ এম ইসলাম