কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ থাই পাংগাসের আমদানি এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটায় মাছ চাষে বৈপ¬বিক পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু পুকুর-দিঘীর ইজারা মূল্যসহ চাষের উপকরণের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির ফলে চাষিরা আর আগের মতো লাভবান না হতে পেরে অনেকটা দিকভ্রষ্ট হয়ে বিকল্প লাভজনক মাছচাষ পদ্ধতি খুঁজতে থাকেন। একদিকে পাংগাসের সহজ চাষ ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন মাত্রা অধিক হলেও পাংগাস চাষে লাভ না থাকলেও চাষি এ মাছ চাষ পরিত্যাগ করতে আগ্রহী নন। অপর দিকে, দেশীয় কার্প জাতীয় মাছের স্বল্প উৎপাদন হার এবং একক আয়তনের জলাশয়ে অধিক লাভের প্রবণতা চাষিকে মাছ চাষের নানা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করে।
সমাধানের উপায় হিসেবে বাণিজ্যিক মাছ চাষিগণ থাই পাংগাসের সাথে নানা প্রজাতির মাছ সাথি ফসল হিসেবে কিভাবে লাভজনকভাবে চাষ করা যায় তার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। পাংগাস মাছের সাথে তেলাপিয়া, কৈ, গলদা চিংড়ি এবং শিং-মাগুর প্রভৃতি মাছচাষ করা হচ্ছে বিগত কয়েক বছর যাবত। নানা বিকল্প মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে বিশেষ করে ব্যাপকভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা অঞ্চলে অত্যন্ত সফলতার সাথে পাংগাস মাছের সাথে তেলাপিয়া (মনোসেক্স) এবং শিং মাছ একত্রে চাষ করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে।
এ পদ্ধতিতে একক আয়তনের জলাশয়ে মাছের উৎপাদন এবং আর্থিক লাভও অনেক বেশি। এখানে লক্ষণীয় যে, উলি¬খিত তিনটি প্রজাতির মাছ এককভাবে চাষযোগ্য তবে এদের একক চাষের তুলনায় মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ অনেক বেশি লাভজনক। জলাশয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি জলাশয়ের তলদেশের পরিবেশ জৈবিক উপায়ে সংরক্ষিত হওয়ায় এ পদ্ধতি বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ এবং মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য লাভজনকভাবে এ মাছচাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
চাষের জন্য স্থান নির্বাচনঃ- বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য আলোচ্য মাছচাষ কল্পে ধান ক্ষেতকে স্বল্প গভীরতায় বেড়ী বাঁধ দিয়ে ঘেরে (Paddy Land Temporarily Converted to Low Depth Pond) পরিণত করা জলাশয় বেশ উপযোগী। তবে যে সকল জলাশয় সহজে শুকানো যায়, প্রয়োজনমত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, উৎপাদিত মাছ ও খাদ্য উপকরণ সহজে পুকুর পাড়ে পরিবহন করার মতো যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে এবং সর্বোপরি পর্যাপ্ত সূর্যের আলো দীর্ঘ সময় পুকুরে পড়ে এরূপ পুকুর নির্বাচন করতে হবে। উপযুক্ততা বিবেচনা না করে যে কোনো পুকুরে এ ধরনের অগ্রসর পদ্ধতির মাছ চাষ করতে গেলে সফলতা পাওয়া কঠিন হয়।
পুকুর প্রস্তুতিঃ- চাষের পুকুর অবশ্যই ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুর শুকানোর পর চুন প্রয়োগ করতে হবে শতকে এক কেজি হারে। পুকুরের তলদেশে যদি কাদা থেকে যায়, তবে চুন কাদার সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পুকুরে যদি ইতোপূর্বে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা হয়ে থাকে তবে চুনের পাশাপাশি শতকে ৫০০ গ্রাম হারে পটাশ সার (Murate of Potash) দিতে হবে। চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা এক মিটার হওয়া উত্তম। পুকুরে কোনো প্রকার জৈব সার দেয়া যাবে না।
পোনা মজুদঃ- পোনা মজুদের জন্য পরিচিত মৎস্য খামার থেকে ভালোমানের পাংগাস (১৮-২০ সেমি), তেলাপিয়া (৬-৮ সেমি) এবং শিং মাছের (৭-৮ সেমি) পোনা সংগ্রহ করতে হবে। সাথে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ছাড়তে হবে ১৪-১৬ সেমি আকারের। এ আকারের পোনা পাওয়া নিশ্চিত করা এবং চাষে অধিক লাভবান হবার জন্য ধানি পোনা সংগ্রহ করে নিজস্ব পুকুরে উপযুক্ত আকার পর্যন্ত বড় করে নিতে হবে। চাষের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে ভালোমানের উপযুক্ত আকারের পোনার ওপর। একটি এক একর পুকুরে পোনা ছাড়ার পরিমাণ নিম্নে দেয়া হলো:
খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ- মাছের খাদ্য প্রদানের মূল নীতি হলো, মাছ যে পরিমাণ খাবার খেতে পারে ঠিক সেই পরিমাণ খাদ্য প্রতিদিন সময়মত নির্ধারিত স্থানে প্রদান করা। সে উদ্দেশ্যে পোনা ছাড়ার পর হতে নিয়মিতভাবে দিনে দুবার মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ১০-৩ ভাগ হারে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্যে আমিষের ভাগ ৩০% হতে হবে। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির বাণিজ্যিক খাবার (Pillet Feed) এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন মাছ সবটুকু খাবার খেয়ে ফেলে। কারণ অভুক্ত খাদ্য পচে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্যের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ফিড ট্রে (Feeding Tray) পদ্ধতি উত্তম। এক একর পুকুরে ১ মি. × ১ মি. মাপের ২০টি ট্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ট্রেসমূহ পানি থেকে ০.৫ মি. গভীরতায় ঝুলিয়ে দিতে হবে। বাঁশের চাটাই দ্বারা মাচা (Platform) তৈরি করেও তার উপর খাবার দেয়া যেতে পারে। খাবার দেবার ১ ঘন্টা পরে ফিড ট্রে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে মাছ সব খাবার খাচ্ছে কি না। সব খাবার গ্রহণ না করলে খাদ্য প্রদান অবশ্যই কমিয়ে দিতে হবে।
মাছের নমুনাকরণ এবং খাদ্য সমন্বয়ঃ- বাণিজ্যিক মাছ চাষের পুকুরে খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ চাষ করার প্রতি ১২-১৫ দিন পরপর কাস্ট নেট দিয়ে ছোট অবস্থায় বেশি এবং বড় হলে কমপক্ষে ৫০টি মাছ ধরে গড় ওজনের মাধ্যমে মোট মাছের ওজন (Biomass) হিসাব করতে হবে। মাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে খাদ্য প্রয়োগের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। তবে কমাবার হার বা খাদ্য প্রয়োগের হার প্রকৃতপক্ষে মাছের খাদ্য গ্রহণ এবং পানির পরিবেশের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। পানির রং ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আবার নতুন তৈরি জলাশয়ে যে পরিমাণ খাদ্য মাছকে দেয়া যায় পুরাতন পুকুরে সে পরিমাণ খাদ্য দেয়া যায় না অর্থাৎ পুরাতন পুকুরের পানি দ্রুত সবুজ হয়ে আসে। ফলে, খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হয়। খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (Food Conversion Ratio) অধিক হলে জলাশয়ের পরিবেশ ভালো থাকে বিধায় ভালো মানের খাদ্য কম হারে প্রয়োগ করে মাছের বেশি বর্ধন পাওয়া যায়। আবার যে সব পুকুরে নিয়মিত পানি পরিবর্তন করা হয় সে সব পুকুরের মাছ বেশি খাদ্য খায়। ফলে এক্ষেত্রে খাদ্য বেশি দিতে হয়। এক কথায় মাছকে যত বেশি খাবার খাওয়ানো যাবে মাছের বর্ধন তত দ্রুত হবে এবং মাছের উৎপাদনও বেশি পাওয়া যাবে।
অন্যান্য পরিচর্যাঃ- পুকুর/ঘেরের পানির পরিবেশ ভালো রাখার জন্য (অবস্থা বুঝে) ঘেরের পানি আংশিক পরিবর্তন করতে হবে এবং প্রতি ১৫ দিন অন্তর শতকে ২৫০ গ্রাম হারে চুন ও খাদ্য লবণ একত্রে বা পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়াও অবস্থা বুঝে শতকে ২৫০ গ্রাম হারে পটাশ সারও প্রয়োগ করতে হতে পারে। এ সকল পদক্ষেপ ছাড়াও ঘেরের তলদেশে জমে থাকা ক্ষতিকর গ্যাস অপসারণের জন্য ২-৩ দিন পর পর দুপুরের সময় পানিতে নেমে অথবা হররা টেনে পানির তলদেশ আলোড়িত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
পুকুরে গ্যাস সৃষ্টির প্রধান কারণ খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ জমা হওয়া। খাদ্য প্রয়োগের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য কোনো ভাবেই প্রয়োগ করা না হয়। মাছ চাষে পুকুরের পানি অধিক সবুজ, পুকুরের তলদেশে ক্ষতিকর গ্যাস সৃষ্টি হওয়া ও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিলে অনেক সময় কিছু মাছ মারাও যেতে পারে। পুকুরের সার্বিক পরিবেশ ভালো রাখার জন্য জিওলাইট, একুয়াম্যাজিক এবং ক্ষতিকর গ্যাস হতে মাছ রক্ষার জন্য গ্যাসনেক্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
অক্সিজেনের অভাব হলে পুকুরে পানি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানি অধিক সবুজ হয়ে গেলে পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ কমিয়ে দিতে হবে। তুতে বা অন্যান্য কিছু রাসায়নিক দ্রব্য (Blue Lagoon) ব্যবহার করে সাময়িকভাবে সবুজভাব (Phytoplankton) দূর করা গেলেও তা ক্ষণস্থায়ী হয়। পুকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ থাকলে খাবার দিলে মাছ পানির উপরের স্তরে চলে আসে বিধায় শিকারী পাখি দ্বারা মাছ ধরে নেবার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য পুকুরের উপর নেট দ্বারা আবৃত করে দেয়া যেতে পারে। এভাবে ৮-৯ মাস চাষের পর পাংগাস মাছ গড়ে প্রায় ১০০০-১১০০ গ্রাম ওজনের হয়। এসময় পাংগাস মাছসহ অন্যান্য মাছ বাজারে পাঠানোর উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
পাঙ্গাসের সাধারণ রোগ বালাই
- শীতকালে অপোকৃত নিম্ন তাপমাত্রায় Trichodina এবং Apisomia নামক বহিঃ পরজীবী দ্বারা অথবা পানির গুণাগুণ সহনীয় মাত্রায় না থাকলে পাংগাস মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে।
- পাংগাস মাছ লালচে দাগ রোগে আক্রান্ত হলে ত্বক ও পাখনার গোড়ায় লালচে দাগ স্পষ্ট দেখা দেয় এবং কখনও কখনও মুখে ঘা দেখা দেয়। এ রোগে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোস্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় মাছ অস্থির ও এলোমেলোভাবে সাঁতার কাটে।
- পুকুরে পাংগাস মাছ বহিঃ পরজীবী বা ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত হলে আক্রান্ত মাছগুলোকে জাল টেনে উঠিয়ে ১ মিলি/লিটার পানিতে ফরমালডিহাইড দ্রবণে গোসল করিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- আক্রান্ত পুকুরে শতাংশে ০.৫-১.০ কেজি হারে কলিচুন প্রয়োগ করলে পরিবেশের উন্নয়ন হয়।
- শীতকালে সপ্তাহে ১-২ দিন পরিমিত পরিমাণে ডিপ টিউবয়েলের পানি পুকুরে সরবরাহ করলে পাংগাস মাছ এ ধরণের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
- লালচে দাগ বা লেজ ও পাখনা পচা রোগে পাংগাস আক্রান্ত হলে ০.২৫ মিগ্রা/লিটার মাত্রায় এক্রিফাভিন বা ম্যালাকাইট গ্রিন দ্রবণে আক্রান্ত মাছকে ১-২ মিনিট গোসল করিয়ে পুনরায় পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে অথবা প্রতি কেজি দেহ ওজনে ১০ মিগ্রা. টেট্রাসাইকিন ইনজেকশন ১ সপ্তাহে ২ বার দিতে হবে অথাব প্রতি কেজি খাবারের সাথে ৫০ মিগ্রা. টেট্রাসাইকিন মিশিয়ে ৭ দিন খাওয়ালে লেজ ও পাখনা পচা রোগ ভাল হয়।
- আরগুলাস বা উকুন দ্বারা পাঙ্গাস মাছ আক্রান্ত হলে প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম (৪-৫ ফুট পানি) করে ডিপটারেক্স সপ্তাহে অন্তর ২ বার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
লেজ ও পাখনা পচা রোগ
প্রাথমিক ভাবে Aeromonas ব্যাক্টেরিয়া পরে ফাংগাল ইনফেকশন, লেজ ও পাখনায় সাদা দাগ, রং ফ্যাকাশে, চলাফেরায় ভারসাম্য হারায় এবং একসময় মারা যায়।
- চিকিৎসা – প্রতি কেজি খাবারে ১ গ্রাম হারে কোরোমাইসিন বা পুকুরে ২৫-৪০ গ্রাম/দিন হারে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা চুন ১০ গ্রাম/দিন (৫ দিন পর পর ৩ ডোজ)।
পেটফুলা (ড্রপসি) রোগ
- প্রাথমিক ভাবে ভাইরাস ও পরে Aeromona ব্যাক্টেরিয়া এই রোগ ছড়ায়
- পট ফুলে বেলুনের মত হয়, পায়ু ফুলে লাল বর্ণ হয়
- মাছ চলাফেরায় ভারসাম্য হারায় এবং কিনারায় জমা হয়ে একসময় মারা যায়।
- চিকিৎসা – প্রতি কেজি খাবারে ১ গ্রাম হারে কোরোমাইসিন বা পুকুরে ২ ppm হারে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা চুন ১০০ গ্রাম/দিন (৫ দিন পর পর ৩ ডোজ)
সাদা দাগ রোগ
ইকথায়োপথিরিয়াস মালটিফিরিস নামক পরজীবির কারনেই এই রোগ হয় । ত্বক ও পাখনায় সাদা দাগ হয় ও দাগের স্থানে ত সৃষ্টি হয়ে মাছ মারা যায়।
- চিকিৎসা – ৩% লবন পানিতে মাছকে আধাঘন্টা গোসল করানো যেতে পারে, মাসে দুই বার চুন ২০০ গ্রাম/দিন হারে প্রয়োগ করতে হবে।
লার্নিয়া সংক্রমণ
- এইসব পরজীবি মাছের গায়ে লেগে থেকে বিরক্তির উদ্রেক করে।
- মাছ লাফালাফি করে।
- অনেক সময় দুর্বল ও অবশ হয়ে যায়।
- নীলাভ-ধূসর মিউকাস দ্বারা মাছের শরীর আবৃত হয়।
- ছোট মাছ বেশি আক্রান্ত হয়।
- ফুলকার টিস্যু ফুলে যায় ও তিগ্রস্ত হয় ফলে মাছের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
সতর্কতা
- উন্নত পরিবেশ সংরণ ও সুষম খাবার প্রয়োগ।
- অতিরিক্ত মাছ মজুদ পরিহার।
- পুকুর জীবাণু মুক্তকরণ (চুন প্রয়োগের মাধ্যমে)।
- পোনা মজুদের পূর্বে চুন প্রয়োগ।
চিকিৎসা
- ২৫ পিপিএম ফরমালিন আক্রান্ত পুকুরে প্রয়োগ।
- ০.৫-০.৭ পিপিএম CuSO4 আক্রান্ত পুকুরে প্রয়োগ।
- ২-৩% NaCl – ৫-১৫ মিানট মাছকে ধৌতকরণ ।
আরগুলাস সংক্রমণ (লক্ষণ)
- এটি এক ধরণের উকুন । এর আক্রমণে ছোট মাছের েেত্র দৈহিক ভারসাম্যহীনতা পরিলতি হয় ।
- মাছকে বিভিন্ন কঠিন বস্তুর সাথে গা ঘষতে দেখা যায়।
- আক্রান্ত স্থানে একটি গোলাকার গর্ত পরিলতি হয় যা অনেক সময় গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে।
- আক্রান্ত স্থানের চারপাশ ফুলে যায়।
- মাছের আক্রান্ত অংশ পানিতে বিদ্যমান ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণুর প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
পুকুরে চিকিৎসাঃ- ০.২৫ পিপিএম ডিপটারেক্স সপ্তাতে ১ বার হিসেবে পর পর ৩ বার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মাছের চিকিৎসাঃ- আক্রান্ত মাছের শরীর থেকে ফরসেপের সাহায্যে উকুন উঠিয়ে ফেলা যায়। তারপর ১০ পিপিএম পটাশ অথবা ৫ পিপিএম সোডিয়াম কোরাইড দ্রবণে ১০-৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। তবে উল্লেখিত চিকিৎসার সময়সীমা মাছের সহ্য মতার সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।
ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ
কলামনারিস সংক্রমণ (লক্ষণ)
- প্রাথমিক পর্যায়ে মাছের মাথা, ত্বক, ফুলকা ও পাখনায় সাদা দাগ দেখা যায়।
- এইসব সাদা দাগ পরবর্তীতে লাল অংশ দ্বারা পরিবেষ্টিত হতে দেখা যায়।
- মাছের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ সচরাচর আক্রান্ত হয় না।
চিকিৎসাঃ- যেহেতু এই রোগ প্রাথমিকভাবে শরীরের বাহ্যিক অংশকে আক্রমণ করে তাই বাহ্যিক চিকিৎসা অনেকাংশে সফল হয়ে থাকে।
চৌবাচ্চায় চিকিৎসা
- ফরমালিন – ২৫০ পিপিএম দ্রবণে মাছকে ১ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে।
- কপার সালফেট – ২৫০ পিপিএম দ্রবণে ১ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে।
পুকুরে চিকিৎসাঃ- ফরমালিন – ২৫ পিপিএম, ৩-৪ বার, ১ দিন পর পর পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
এন্টিবায়োটিক প্রয়োগঃ- অক্সিটেট্টাসাইকিনঃ প্রতি কেজি মাছের জন্য ৫০-৭৫ মি.গ্রা হিসেবে পর পর৫-১০ দিন খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। মাছের বয়স ও রোগের তীব্রতার সাথে উল্লেখিত মাত্রার পরিবর্তন হতে পারে।
স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণ(লক্ষণ)
- শারিরীক দুর্বলতা ও চলাফেরায় শৈথিল্য।
- ক্ষুধামন্দা।
- পায়ুপথ ফ্যাকাশে লাল হওয়া।
- লালচে চক্ষু, ফুলকা ও মাংশ পেশী ।
- মাছের কলিজা, বৃক্ক ও প্লীহা ফুলে যাওয়া।
- মাছ খাড়াভাবে বৃত্তাকারে সাঁতার কাটে।
- চোখ বাইরের দিকে বের হয়ে যায় ও কর্নিয়া অস্বচ্ছ হয়ে যায়।
এন্টিবায়োটিক প্রয়োগঃ- ইরাইথ্রোমাইসিনঃ ৫০ মি.গ্রা./কেজি মাছের জন্য/দিন/৪-৭ দিন খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
মোটাইল এরোমোনাড সেপটিসেমিয়া (লক্ষণ)
- এইসব রোগের সাধারণ লণসমূহ স্ট্রেপটোকক্কাসে আক্রান্ত মাছের লণের সাথে প্রচুর মিল রয়েছে।
- মাছের চলাফেরায় শৈথিল্য ও শারীরিক দুর্বলতা
- ক্ষুধামন্দা
- ফ্যাকাশে লাল পায়ুপথ ও পাখনার গোড়া
- লালচে চুক্ষু
- শরীরে বিস্তৃতি ও গভীর তের সৃষ্টি হওয়া
- পেটে তরল পদার্থ জমা হওয়া
- মাছের বৃক্ক, প্লিহা ও যকৃত ফুলে যাওয়া
চিকিৎসা
- KMnO4- ৪ পিপিএম (৪ গ্রাম/m3)/ ৩ দিন, ১ মাস ধরে দিতে হবে ।
- আক্সিটেট্টাসাইকিন – ৫০ মি. গ্রা./কেজি মাছের/প্রতিদিন খাবারের সাথে মিশিয়ে ৪-৭ দিন খাওয়াতে হবে।
রেড স্পট
Pseudomonas spp. (Pseudomonas fluorescens, P. anguilliseptica, P. Chlororaphis) নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা নিম্ন তাপমাত্রায় পাংগাস মাছ আক্রান্ত হতে দেখা যায়। আক্রান্ত মাছের দেহ পৃষ্ঠে লাল দাগ এবং কখনও কখনও ক্ষত দেখা যায়।
চিকিৎসাঃ- KMnO4- ৩-৫ পিপিএম (৩-৫ গ্রাম/m3)/ ৩ দিন, ১ মাস ধরে দিতে হবে ।
রক্ত সংক্রমণ
Edwardsiella tarda নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মাছ আক্রান্ত হয় ।
চিকিৎসাঃ- BKC (Benzal Konium Chloride)৭-১০ দিন মাছকে ধৌতকরণ
খাবারের সাথে –
Oxytetracyline:৫৫ – ৭৭ সম/শম ৭-১০ দিন
Streptomycin:৫০ – ৭৫ সম/শম ৫-৭ দিন
Kanamycin:৫০ সম/শম ৭ দিন
Sulfamid: ১৫০ – ২০০ সম/শম ৭-১০ দিন
ছত্রাকজনিত রোগঃ- তেলাপিয়ার খামার বিশেষ করে হ্যাচারীতে ছত্রাক সংক্রমণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা । ছত্রাক সাধারণত দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণকারী জীবাণু হিসেবে পরিচিত । মাছের ত্বক, পাখনা, ফুলকা ও ডিমের উপরেরর দিক কোন কারনে য় ছিঁড়ে গেলে ছেঁড়া অংশে ছত্রাক সংক্রমণ হয়। ছত্রাক সংক্রমণের ফলে ডিম বা লার্ভি মারা যায় ।
লক্ষণ
- মাছের গায়ে বা ডিমের উপর সাদা তুলার মত অবরণ দেখা যায়, তবে অন্যান্য বস্তুর সাথে মিশে এর রং পরিবর্তিত হতে পারে ।
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর রং বাদামী হতে দেখা যায় ।
- ছত্রাকের শাখা-প্রশাখা মাছের ত্বকে বিস্তার লাভ করে, ফলে শরীরের লবণ-ভারসাম্যতা বিনষ্ট হয় ও মাছ মারা যায় ।
সতর্কতা
- পুকুর/হ্যাচারী জীবাণুমুক্ত ও পরিচ্ছন্নকরণ।
- হ্যাচারী কর্মীর পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ।
- হ্যাচারী যন্ত্রপাতির পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ।
- মাছ ধরা, পরিবহন, জালটানাসহ প্রতিটি কাজে এমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন মাছের উপর কোন চাপ সৃষ্টি না হয়। ডিম ও লার্ভির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
চিকিৎসাঃ- ৩০,০০০- ৫০,০০০ পিপিএম লবণ পানিতে আক্রান্ত মাছকে, ৩-৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, তবে চিকিৎসার সময়কাল মাছের সহ্যমতার উপর নির্ভরশীল। প্রয়োজনে চিকিৎসার পুনরাবৃত্তি করতে হবে ।
গ্রন্থণা ও সম্পাদনাঃ ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেন, ড. মোঃ শাহাআলী, ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, ড. মোঃ আব্দুল ওহাব, ড. মোঃ সাইফুদ্দিন শাহ্।