এসএম মুকুল : বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট সবজি উৎপাদন হয় ২২ লাখ টন, যেখানে ১৯৭০ সালে উৎপাদন হতো মাত্র সাত লাখ টন। গত তিন দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি। দেশে বর্তমানে প্রায় আট লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে।
রপ্তানির জন্য সবজি প্রস্তুত করছেন চাষীরা _ইন্টারনেটবর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশের শাক-সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদার মাত্র দুই থেকে পাঁচ শতাংশ রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি রপ্তানি হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের সবজি রপ্তানির টার্গেট ছিল ৬৬৫ কোটি টাকা। তবে পণ্য পরিবহনে নানান অসুবিধা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাক-সবজি রপ্তানি করে ৬৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান ও মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রপ্তানি হয়। তবে যেসব দেশে বাংলা ভাষাভাষীরা বসবাস করছে সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজি রপ্তানির চাহিদা বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রবৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে আগামীতে সবজি রপ্তানি খাতে আয় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়। এসব সবজির মধ্যে করলা, কাকরোল, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, ঢেঁড়স, লাউ, কচুরলতি, কচুরমুখী, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, কাঁঠাল, শসা, চিচিঙ্গা, লালশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, পটল, ঝিঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত সবজির মধ্যে_ ডাঁটা, কচুরলতি, শিমের বিচি, কাঁচাকলা, কলার ফুল, কচুশাক, কাঁঠালের বিচি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উৎপাদনে রেকর্ড
দেশের চাষযোগ্য জমির মাত্র ১.৮ শতাংশে শাক-সবজি চাষ হয়। দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিবছর উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে ৪০ ভাগ সবজি নষ্ট হচ্ছে। তাই সবজি রক্ষা এবং রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ ও পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি পর্যবেক্ষক দল শীতকালীন সবজি উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ স্বচক্ষে দেখতে এখন বাংলাদেশ সফর করছে। প্রতিনিধি দলটি দেশের সবজি উৎপাদন এবং গুণগতমান নিয়ে ‘যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছে।
জানা গেছে, এবার রবি মৌসুমে ৫ দশমিক ২৮ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এবার দেশে সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদন হবে। গবেষণার মাধ্যমে উন্নত বীজ উদ্ভাবন ও কৃষিতে আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে দিন দিন সবজি উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ৫০ প্রকার সবজির জাত আবিষ্কার করেছে। এর মধ্যে বারি টমেটো ৪, ৫ এবং ৮, বারি শিম-১, বারি ঢেঁড়স-১ ইত্যাদি সারাদেশে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের কৃষকদের পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার তরুণ উদ্যোক্তা শাক-সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় নিজেদের জমির পাশাপাশি বর্গা জমি নিয়ে সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
বাড়ছে রপ্তানি
রপ্তানির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের সবজি রপ্তানি শুরু হলেও ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ববাজারে ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা। বর্তমানে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, মিরসরাই, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী, মাগুরা, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, কক্সবাজার, সিলেট ও গাজীপুরের সবজি রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বিদেশে বাংলাদেশের শাক-সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদার মাত্র দুই থেকে পাঁচ শতাংশ রপ্তানি করতে পারছেন উদ্যোক্তারা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি রপ্তানি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০ দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফল রপ্তানি হয়। যেসব দেশে বাংলাভাষীরা বসবাস করছে, সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা বেশি। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়।
বিশেষ করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের শাক-সবজি ও ফলের ব্যাপক চাহিদা। শুধু দুবাইয়ে বাংলাদেশি শাক-সবজি ও ফলের চাহিদা রয়েছে প্রতিদিন ৬০ টন; লন্ডনে ৩০ টন। কার্গো বিমান চালু, বিদেশি বিমানগুলোয় পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থা গ্রহণ, যেসব দেশে এসব পণ্যের বাজার আছে সেসব দেশে ফ্লাইট বাড়ানো, চলমান ভর্তুকি অব্যাহত রাখাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া গেলে ব্যাপক সম্ভাবনাময় এখাতে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আরও অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তথ্য উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সবজির ভালো চাহিদা থাকায় দিন দিন বেড়ে চলেছে সবজি রপ্তানি।
বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন সম্ভব
সবজি চাষ এখন লাভজনক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। পাশাপাশি এ খাতে অনেকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। তাই শিক্ষিত যুবসমাজ এখন বেশি মনযোগী হচ্ছে কৃষিভিত্তিক এই লাভজনক প্রকল্পে। ফলে বাড়ছে গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা। বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট সবজি উৎপাদন হয় ২২ লাখ টন, যেখানে ১৯৭০ সালে উৎপাদন হতো মাত্র সাত লাখ টন। তিন দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণের বেশি। দেশে বর্তমানে প্রায় আট লাখ হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের অধিক সবজি উৎপাদন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমানে স্বাভাবিক পর্যায়ে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, শুধু মানসম্মত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ ভাগ সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। এজন্য গ্রামে গ্রামে কৃষকদের গ্রুপ তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উন্নতজাতের বীজ উৎপাদনে দেশের হাজার হাজার নার্সারিকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জানা গেছে, ইরির ফসল প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৪৬ হাজার মহিলা বীজ নিয়ে কাজ করছেন। এই আওতাকে আরও সম্প্রসারিত করে এ কাজে মহিলাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। একটি সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রতিটি পরিবার যদি প্রতিদিন এক কেজি করে সবজি উৎপাদন করে, তাহলে দেড় কোটি বসতভিটা থেকে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন সম্ভব।
লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামের ২০ হাজার পরিবার সবজি চাষ করে সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। সবজি চাষাবাদ করে নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। প্রতি বছর এ উপজেলার তিন হাজারেরও বেশি হেক্টর জমি থেকে প্রায় আট হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। উৎপাদিত এসব সবজির বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকারও বেশি। উপজেলায় প্রতিনিয়তই বাড়ছে চাষির সংখ্যা। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ। কুষ্টিয়া, খুলনা মহাসড়কের ২০ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ শসার ক্ষেত। এ এলাকার ১৪টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের মাঠে এখন শসার চাষ করে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব মতে, রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের মধ্যে রংপুরের মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, পীরগাছা উপজেলা, নীলফামারী সদর, জলঢাকা, ডিমলা, কুড়িগ্রাম সদর, গাইবান্ধা সদর, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, দিনাজপুর সদর, কাহারোলসহ বিভিন্ন স্থানের শত শত সবজি চাষি প্রতিদিন রিকশা ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে সবজি নিয়ে স্থানীয় পাইকারি হাট-বাজারগুলোয় ভিড় করে। এসব জেলা থেকে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার শীতকালীন শাক-সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি সূত্রে বসবাস করছে। রপ্তানির এ বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। এজন্য গ্রামে গ্রামে কৃষকদের গ্রুপ তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উন্নতজাতের বীজ উৎপাদনে দেশের হাজার হাজার নার্সারিকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জানা গেছে, ইরির ফসল প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৪৬ হাজার মহিলা বীজ নিয়ে কাজ করছেন।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক
কৃপ্র/ এম ইসলাম