কৃষি প্রতিক্ষণ রিপোর্টঃ সারাদেশে চলছে আমন কাটার ভরা মৌসুম। পাকা আমন ধানের সুবাতাস বইছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মুখ আছে তৃপ্তির হাসি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিইএ) জানায়, চলতি মৌসুমে ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধান চাষ হয়েছে ৫৫ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে।
কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, চলতি মৌসুমে আমন ধান উৎপাদনে কেজি প্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ১৮ টাকা। এ হিসাবে এক মণ ধানের (৪০ কেজি হিসেবে) দাম দাঁড়ায় ৭২০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে ধানের দাম মণ প্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। তবে ধান একটু শুকনা হলে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারছেন কৃষকেরা। এছাড়া ধানের প্রকার ও মানভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে আমন ধান।
উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কয়েক মাসের পরিশ্রম ফসল ঘরে তুলতে শুরু করেছেন তারা। এখন কৃষকরা যেন ন্যায্য দাম পান সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখা উচিত। নইলে আমন ধান চাষের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবেন কৃষকেরা। ডিইএ এর উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ আবদুহু বলেন, চলতি বছরে আমন ধান উৎপাদন কম হওয়ার যে শঙ্কা ছিল তা আর নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে কৃষকরা এবারো ধানের ভালো ফলন পাবেন। অনেক এলাকায় দ্বিতীয়বার ধান চাষ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে চলছে আমন ধান কাটার ধুম। আর এ নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন স্থানীয় কৃষক ও গৃহস্থরা।
বর্তমানে কৃষিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ধানা কাটা ও ধান মাড়াই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি পক্ষ শুধু ধান কেটে গৃহস্থের বাড়িতে পৌঁছে দেয়, অন্যপক্ষ শুধু মেশিনের মাধ্যমে ধান মাড়াইয়ের কাজ করে।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় আমন ফসলের মাঠে এখন পাকা ধানের সোনালি হাসি। অগ্রহায়ণের উজ্জ্বল রোদে সেই হাসি আরও ঝলমল করে উঠছে। গ্রামবাংলার আকাশে-বাতাসে এখন নতুন ধানের গন্ধ, গ্রামে গ্রামে নবান্নের সাজ সাজ রব। মাঠে মাঠে কৃষকেরা কাসেÍ নিয়ে ধান কাটার উৎসবে নেমে পড়েছেন। শীতের সকাল থেকে শুরু করে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত মাঠে-মাঠে ধান কাটার চিরাচরিত দৃশ্য এখন উপজেলার সর্বত্র। ধান মাড়াই, বাছাই আর শুকানোর কাজে মেতে উঠেছেন এখানকার সব কৃষক পরিবার। অতীতের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রার অধিক জমিতে সোনা রাঙা আমন ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূল থাকায় এ বছর ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এতে কৃষকের মন ভরছে ঠিকই। কিন্তু তা বেশিক্ষণ তাঁদের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তাঁদের উৎপাদন খরচই উঠছে না। উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বড়লেখা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর প্রায় ৮ হাজার ৬১৭ হেক্টর জমিতে আমন ফসল চাষাবাদের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ছিল। চাষাবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩৩ হেক্টর বেশি জমিতে। এ বছর ধানের উৎপাদনও ভালো হয়েছে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ছিল স্থানীয় ও উচ্চ ফলনশীল মিলিয়ে ধানে প্রায় ৩৮৭৭৬.৫ টন। ধানে পোকার আক্রমণ না হওয়া, জমিতে সুষম সার ব্যবহারে কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনে এই সুফল মিলেছে বলে কৃষি অফিস জানিয়েছে। একই কথা কৃষকেরও। সম্প্রতি বিভিন্ন মাঠ ঘুরে ভালো ফসল দেখা গেছে। যেদিকে চোখ যায়, আমন ধানের পাকধরা বিস্তৃত সোনালি রঙের ঢেউ। অনেকে উৎসবের আনন্দে ধান কাটতে শুরু করেছেন। যখনই উৎপাদন খরচ ও ধানের বাজারমূল্যের প্রসঙ্গটি আসছে, তখনই তাদের মন ভারী হয়ে যায়।
উপজেলার নিজবাহাদুর এলাকায় কিছু পতিত জমি দেখিয়ে কয়েকজন কৃষক জানালেন, ধান উৎপাদন করে প্রকৃত খরচটাই তোলা যায় না বলে অনেকে চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভবিষ্যতে এরকম পতিত জমির পরিমাণ বাড়তে পারে। জানা গেছে, প্রতি মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয় ৫শ টাকা থেকে ৬শ টাকা। প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৭শ টাকা থেকে ৭৫০ টাকায়। দাম বেড়ে গেলে কৃষকের এই হতাশা আর থাকবে না।
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, বড়লেখায় আবাদকৃত জমির মধ্যে এবার ৫ হেক্টর জমিতে নতুন জাতের ব্রি ধান-৫৬ চাষ করা হয়েছে। ব্রি ধান-৫৬ আষাঢ়ের শেষ দিকে রোপণ করে আশ্বিনে কাটা যায়। রোপন থেকে শুরু করে ১০০ দিনের মধ্যে ওই ধান কাটা যায়। ধানে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এবার ব্রি ধান-৪৯ এ ভালো ফলন পাওয়া গেছে। ব্রি ধান-৫৬ আগাম পাকে বিধায় কাটার পর সহজেই আলু, গম বা রবিশস্য চাষ করা যায়। এবার ব্রি ধান-৫৬ এর বাম্পার ফলনে কৃষকরা আগামীতে এ জাতের ধান চাষ করতে আগ্রহী হবেন বলে আশাবাদী কৃষি কর্মকর্তারা।
বড়লেখা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা দেবল সরকার জানান, এবার উপজেলায় রোপা আমনের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮৬১৭ হেক্টর। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৮৬৫০ হেক্টর, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ হেক্টর বেশি। ‘যথেষ্ট ভালো ফসল হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন ভালো হয়েছে। বলতে পারি, উৎপাদন সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
এছাড়া টাঙ্গাইল জেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসের শুরু থেকে ধান কাটার ধুম লাগলেও দাম নিয়ে হতাশায় পড়েছেন কৃষকরা। বাজারে ৫৫০-৬৫০ টাকা মণ দরে ধান বিকোচ্ছে। অথচ জমিতেই কৃষকের খরচ হয়েছে মণ প্রতি ৫০০-৬০০ টাকা। এ নিয়ে কৃষকের পরিবারে হা-পিত্যেশ থাকলেও দেখার কেউ নেই। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বর্গাচাষিরা।
কৃপ্র/ এম ইসলাম