কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ‘সাদা সোনা’ খ্যাত গলদা চিংড়ি বিক্রির ভরা মৌসুমেও চাষিদের মুখে হাসি নেই। মাছ কোম্পানিগুলোর ইচ্ছেমাফিক বেঁধে দেওয়া দরে প্রতি কেজিতে চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ফলে লাভের কথা বাদ দিয়ে এখন পুঁজি বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা। জানা গেছে, ভাইরাসমুক্ত পোনার সংকট, অতিবৃষ্টিতে চিংড়ির ঘের ভেসে যাওয়া, চিংড়ির ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, উৎপাদনে কারিগরি জ্ঞানের অভাব ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধিতে আর্থিক ক্ষতির মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন উপকূলের ১০ লাখ চিংড়ি চাষি। খবর বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইনের।
চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে এরই মধ্যে অনেক ঘেরমালিক গলদা-বাগদা চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়া চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ মহামারীর মতো রূপ নিয়েছে। এতে চিংড়ির গুণগত মান যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বিদেশি বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির যে কদর ছিল তা হারিয়ে যেতে বসেছে। জেলা মত্স্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনাসহ উপকূলীয় জেলার প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রতিবছর বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়। এর মধ্যে শুধু খুলনায় চিংড়ি চাষে যুক্ত রয়েছেন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এখানে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে।
চলতি বছর বাগদার উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও কমেছে গলদার। জানা গেছে, স্থানীয় চিংড়ির বাজারগুলোতে গত বছর মাঝারি গ্রেডের যেসব চিংড়ি ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বর্তমানে সেগুলোর দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। ছোট গ্রেডের চিংড়ি গত বছর ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। আর ১২০০ টাকার বড় গ্রেডের চিংড়ির বর্তমান দাম ৯০০ টাকা। মাঝারি গ্রেডের প্রতি কেজি চিংড়ি উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘেরে শ্রমিকের মজুরি, জমির মালিকের হাঁড়ির টাকা ও আনুষঙ্গিক খরচ। ফলে চিংড়ি চাষিরা চলতি বছর বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া ইউনিয়নের মত্স্যচাষি সুনীল সরকার বলেন, ‘বাজারদর বিগত বছরের তুলনায় কেজিতে ৩০০-৪০০ টাকা কম। কোম্পানিতে মাছের কোনো রেট (দাম) নেই। এতে আসল পয়সাও কারও ঘরে যাবে না, শতভাগ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’ ঘের ব্যবসায়ী হায়দার আলী বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে এবার অতিবৃষ্টিতে ঘের ভেসে যাওয়ায় অনেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। এখন চিংড়ি বিক্রিতে লোকসান হওয়ায় দেনার টাকা কীভাবে শোধ করব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ চাষি উৎপাদিত চিংড়ি সরাসরি কোম্পানিতে বিক্রির সুযোগ পান না।
কমপক্ষে তিনবার হাত-বদলের পর তা কোম্পানিতে পৌঁছায়। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে অনেক চাষি চিংড়ির ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়া কোম্পানিগুলো চিংড়ির টাকা সময়মতো পরিশোধ না করায় এবং কম দামে অসাধু ডিপোমালিকদের পুশকৃত চিংড়ি ক্রয় করায় খেসারত দিতে হয় সাধারণ চিংড়ি চাষিকে। ডুমুরিয়ার বড়ডাঙ্গা গ্রামের মিলন বালা জানান, প্রতিবছর মাছ ধরার মৌসুমে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চিংড়ির দাম কমানো হয়। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন চাষিরা। তবে মধ্যস্বত্বভোগী ডিপোমালিকরা বলছেন, কোম্পানিগুলো গত বছরের তুলনায় এবার চিংড়ির দাম কমিয়ে নির্ধারণ করেছে। ফলে বাজার থেকে বেশি দামে মাছ কিনলে তাদেরই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম জহির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গলদা রপ্তানিতে বর্তমানে দেশে-বিদেশে একটা স্থবির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গলদার চাহিদা কমে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ : খুলনার রূপসা, ডুমুরিয়া উপজেলাসহ আশপাশ এলাকায় চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের ঘটনাটি উদ্বেগজনকভাব বেড়েছে। মাছের ওজন বাড়াতে ডিপোগুলোতে সিরিঞ্জের মাধ্যমে সাবু ও জেলিজাতীয় পদার্থ পুশ করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলেও অপদ্রব্য পুশ বন্ধ হচ্ছে না। জানা গেছে, ডিপোগুলোতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার পর তা ট্রাকে করে খুলনা ও চট্টগ্রামের মাছ কোম্পানিতে বিক্রি করা হয়। র্যাব ও পুলিশের অভিযানে কাছাকাছি সময়ে খুলনার রূপসা ও ডুমুরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ পুশ করা চিংড়ি উদ্ধার হয়। জেলা মত্স্য কর্মকর্তা শামীম হায়দার জানান, পুশ বন্ধে মত্স্য অধিদফতর, ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। এ ছাড়া পুশের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা হয়েছে। ভাইরাসমুক্ত পোনার সংকট : খুলনায় গুণগত মানের বাগদা ও গলদা পোনার তীব্র সংকট রয়েছে।
খুলনার হ্যাচারিগুলো থেকে চাহিদার ১০০ ভাগের মধ্যে ২০ ভাগ পোনা সরবরাহ করা যায়। বাকি ৮০ ভাগ পোনা নদী থেকে ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে সংগ্রহ করা হয়। চিংড়ি ব্যবস্থাপনায় কাজ করা ওয়ার্ল্ড ফিশের কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানান, মানসম্মত পোনার অভাব ও চাষিদের দক্ষ কারিগরি উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে। কারিগরি জ্ঞানের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে হ্যাচারি থেকে জীবাণুমুক্ত চিংড়ি পোনা সরবরাহ করতে পারলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি : এবার অতিবৃষ্টিতে ঘেরের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়েছে।
এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় বস্তাপ্রতি চিংড়ির খাবারের দাম বেড়েছে ৪০০ টাকা। চিংড়ি চাষের জন্য ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ দেওয়া হয় না। এ কারণে সরকারিভাবে চিংড়ির বীমা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কোম্পানির মালিকরা। ফ্রোজেন ফুড পরিচালক এস হুমায়ুন কবির জানান, ব্যাংকগুলো চিংড়ি চাষে ঋণের ব্যবস্থা করলে চাষিদের পক্ষে ভালো মানের পোনা সংগ্রহ করে উন্নত ব্যবস্থাপনায় চিংড়ি চাষ করা সম্ভব হবে। অতিবৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া : গেল আগস্টে খুলনায় দুই দিনের রেকর্ড পরিমাণ অতিবৃষ্টিতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মত্স্য সম্পদের ক্ষতি হয়। চিংড়ির ঘেরসহ ভেসে যায় প্রায় ৪৭ হাজার পুকুর ও দিঘি।
রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা : বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও চিংড়ি রপ্তানিতে ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছেন রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক এস হুমায়ুন কবির বলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে বর্তমান রপ্তানির প্রায় দ্বিগুণ ১৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ১৩ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানি করতে চায় বাংলাদেশ। তবে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারি নীতিমালার পরিবর্তন করা জরুরি। একই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষের অবকাঠামো গড়ে তোলা, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে হ্যাচারির মাধ্যমে পোনার সরবরাহ বৃদ্ধি, আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান ও ঝুঁকি কমাতে ‘চিংড়ি বীমা’ চালু করতে হবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম