চাষা আলামীন জুয়েল: সবজি বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। এদেশে প্রায় ৮৯ প্রকারের শাক-সবজি চাষ হয়ে থাকে। বেগুন, কুমড়া জাতীয় সবজি,করলা, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙে, পটল, চিচিংগা, কাকরোল, উচ্ছে, তরমুজ, বাংগী, ফুলকপি, বাধাকপি এসব উল্লেখযোগ্য। এসব সবজি উৎপাদন করতে আমাদের প্রায়শই প্রকৃতির কাছে মাঝে মাঝেই অসহায় হতে হয়। সবজি উৎপাদনে প্রাকৃতিক শত্রুগুলোর মধ্যে পোকামাকড় অন্যতম। বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে বেগুনের ফলন মারাত্বকভাবে হ্রাস পায়। অন্যদিকে কুমড়া জাতীয় সবজির মাছি পোকাও অত্যন্ত ক্ষতিকর পোকা। যার আক্রমনে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। ফলে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে অযাচিত উপায়ে কীটনাশক ব্যবহার করে। এতে কৃষি পরিবেশ দূষিত হয়। তাছাড়া বিষযুক্ত সবিজ খেয়ে মানুষ নানাবিধ রোগ আক্রান্ত হয়। সম্প্রতি বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে সেক্সফেরোমোন ফাঁদ নামে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে যার দ্বারা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং কুমড়া জাতীয় ফসলের ফলের মাছি পোকা কার্যকরভাবে দমন করা সম্ভব। তাছাড়া ফল জাতীয় গাছের মধ্যে আম, লিচু, পেয়ারা এসব গাছেও আজকাল সেক্সফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে অনেকে এই ফাঁদকে জাদুর বাক্স বা তাবিজও বলে থাকে।
পুরুষ পোকাকে প্রজনন কাজে আকৃষ্ট করার জন্য স্ত্রী পোকা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা সেক্সফেরোমোন নামে পরিচিত। সেক্সফেরোমোন প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ,তাই এটি পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। ইহা সম্পূর্ণভাবে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি। কম খরচে কম সময়ে ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর ব্যবহার বিধি খুবই সহজ। স্থানীয় উপকরণ দিয়ে ফাঁদ তৈরি করা যায়। সেক্সফেরোমোন ব্যবহারে ফসলের গুণগত মান ভালো পাওয়া যায়।
সেক্সফেরোমোন ফাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে সেক্সফেরোমোন টোপ (লিউর বা কিউলিউর) ফাঁদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফাঁদটি মাঠে স্থাপনের জন্য খুঁটি প্রয়োজন হয়। সেক্সফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো পোকার উপস্থিতি মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করা। তাছাড়া পোকার প্রজনন কাজে বাঁধার সৃষ্টি করে পোকার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা।
বিভিন্ন প্রকার সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ পাওয়া যায়। যথা ডেল্টা ফাঁদ, উইং বা ডানা ফাঁদ, ফানেল ফাঁদ এবং পানি ফাঁদ এসব প্রচলিত রয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে পানি ফাঁদ পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।
পানি ফাঁদ তৈরির পদ্ধতি—
প্রায় তিন লিটার পানি ধরে এবং প্রায় ২২ সে.মি লম্বা গোলাকার বা চারকোনা বিশিষ্ট প্লাস্টিকের পাত্র বা বৈয়াম দিয়ে এ ফাঁদ তৈরি করা যায়। বৈয়ামের উভয় পাশে ১০ থেকে ১২ সে.মি চওড়া এবং ১১ থেকে ১২ সে.মি উঁচু পরিমাণ অংশ ত্রিভূজের মত করে কেটে নিতে হবে। পাত্রের তলা হতে কাটা অংশের নিচের দিকে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ সে.মি পর্যন্ত সাবান মিশ্রিত পানি দিয়ে ভরে রাখতে হবে। বৈয়ামের ঢাকনার মাঝে কালো রংয়ের একটি ল্যুপ বসানো থাকে। ল্যুপের নিচের ছিদ্রে চিকন তার বাঁধা হয়। তারের অপর মাথায় ফেরোমোন সম্বলিত টিউব বা লিউরটি এমনভাবে বাঁধতে হবে যেন লিউরটি সাবান মিশ্রিত পানি হতে ২ থেকে ৩ সে.মি উপরে ঝুলতে থাকে। সেক্স ফেরোমোননের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ পোকা বৈয়ামের ভেতরে প্রবেশ করে এবং লিউরটির চারপাশে উড়তে যেয়ে সাবান মিশ্রিত পানিতে পড়ে মারা যায়। যতেœর সাথে ব্যবহার করা হলে একটি ফাঁদ ৩ থেকে ৪ মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
জমিতে ফাঁদ স্থাপনের সময় এবং পদ্ধতি—
বেগুন ফসলের জমিতে সাধারণত চারা রোপণের ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর থেকে বেগুনের কচি ডগায় ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। এজন্য বেগুনের চারা রোপণের ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর থেকে ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। কুমড়া জাতীয় ফসলের জন্য ফুল ফোটার আগেই জমিতে ফাঁদ বসাতে হবে। সফলভাবে পোকা দমনের জন্য শেষবার ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফেরোমোন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ সাধারণত জমির আইলের ২.৫ মিটার ভিতর থেকে শুরু করে ১০ মিটার দূরে দূরে বর্গাকারে স্থাপন করতে হবে। কুমড়াজাতীয় ফসলে ১২ মিটার, ফল বাগানে ১২ মিটার এবং কপি সবজি ক্ষেতে ২৫ মিটার দুরত্বে স্থাপন করতে হবে। বেগুন ক্ষেতে বিঘাপ্রতি ১৩ থেকে ১৪ টি ফাঁদ, কুমড়াজাতীয় সবজি ক্ষেতে বিঘা প্রতি ১১ টি, ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণে বিঘা প্রতি ১১ টি এবং কপি সবজি ক্ষেতে ৬ টি ফাঁদ বসাতে হবে। সাধারণত দুটি খুঁটি শক্তভাবে স্থপন করতে হবে। তারপর ফাঁদটিকে তার বা সুতলি দিয়ে শক্ত করে খুঁটির সাথে বাঁধতে হবে। সবজি ফসলের মাঠে উত্তর দক্ষিণ মুখ করে ফাঁদটি বসাতে হবে। এতে বাতাসকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফসলের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ফেরোমোন ফাঁদের উচ্চতাও বাড়াতে হবে। বেগুন গাছের ঠিক উপরে, কুমড়া জাতীয় গাছের মাচা বরাবর ঝুলিয়ে এবং আম, পেয়ারা গাছে মাটি থেকে হাত উচিয়ে যতটুকু উঠানো যায় ঠিক ততোটুকু উচ্চতায় সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ স্থাপন করতে হয়।
জমিতে ফাঁদ স্থাপনের পর করণীয়—
সপ্তাহে কমপক্ষে দুই দিন ফাঁদের পানি পরীক্ষা করে মরে থাকা পোকা ফাঁদের পানি থেকে আঙ্গুল বা কাঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। ৩ থেকে ৪ দিন পরপর সাবান পানি পাল্টে দিতে হবে। সাবান পানি স্তর সবসময় যেনো ৩ থেকে ৪ সে.মি পুরু থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ফাঁটা বা ছিদ্রযুক্ত ফাঁদ পাল্টিয়ে নতুন ফাঁদ প্রতিস্থাপন করতে হবে। গাছের বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ফাঁদটিকেও আস্তে আস্তে উপরের দিকে তুলে দিতে হবে বিশেষ করে বেগুনে জমিতে। বেগুনের জমিতে নির্দিষ্ট সময় পর পর লিউর পরিবর্তন করে দিতে হবে। তবে অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে পুরো মৌসুমের জন্য একটি ফেরোমোন লিউরই যথেষ্ট।
বিশেষ সাবধানতা ও করণীয়:
বেগুন ও কুমড়া জাতীয় ফসলের জন্য আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট সেক্স ফেরোমোন লিউর ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া লিউরগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা রয়েছে। ফলে লিউরগুলো ব্যবহারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বেগুন ও কপিতে ব্যবহারের জন্য লিউরগুলো অবশ্যই ডিপ ফ্রিজে রাখতে হয়। তা না হলে লিউরের কার্যক্ষমতা দিনে দিনে কমে যায়। অন্যদিকে কুমড়াজাতীয় এবং আম, লিচু, পেয়ারা এসব ফলের লিউরগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটর বা নরমাল ফ্রিজে রাখা যায়। লিউরের ভিতর কিছু দেখা না গেলেও তা খুলে দেখা যাবে না। একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বেগুনের একটি লিউর চারপাশে সর্ব্বোচ্চ ১০ মিটার দুরত্ব পর্যন্ত কার্যকারিতা বিস্তার করতে পারে। অন্য একটি লিউর তার অবস্থান থেকে চারপাশে ১০ মিটার দুরত্ব পর্যন্ত কার্যকারিতা বিস্তার করতে পারে। তাই একটি লিউর থেকে অন্য একটি লিউরের দুরত্ব ২০ মিটার হওয়া উচিত। এভাবে অন্যগুলোও ব্যবহার করতে হবে।
প্রতিদিন ফাঁদ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মরা পোকাগুলো প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে ফাঁদটি উপরে তুলে দিতে হবে। বেগুন, কপি সবজির লিউরগুলো খুলে দেখা যাবে না। লিউরগুলো ভেজানো যাবে না। লিউর এর প্যাকেট খোলা রাখা যাবে না। তাছাড়া প্যাকেট খোলার সাথে সাথে লিউর ব্যবহার করা উচিত।
প্রাপ্তিস্থান—
বালাইনাশকের দোকানে লিউর পাওয়া যায়। তবে লিউর কেনার আগে অবশ্যই উপসহকারি কৃষি অফিসার বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা উচিত। তাদের পরামর্শ মোতাবেক লিউর কেনা ও সবজি মাঠে স্থাপন করা উচিত।
আলহামদুলিল্লাহ ,খাদ্য শস্য উৎপাদনে আমরা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর বর্তমানে বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সবজি উৎপাদনে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট আজ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের এক যুগান্তকারী পদ্ধতি হলো সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ। গুণগত মানের ফসল উৎপাদনে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ খুবই উপযোগী ও কার্যকরী। প্রতিটি কৃষকই ব্যবহার করুক এই জাদুকরী বাক্স, এগিয়ে যাক আরো একধাপ,সমৃদ্ধির পথে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার —কৃষিবিদ মোহাইমেনুর রশীদ
সকল কৃষক বন্ধুদের জন্য শুভ কামনায় —চাষা আলামীন জুয়েল