কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বাংলাদেশে প্রতিদিন ১ কোটি ৮০ লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদিত হয়, যা দেশের চাহিদার অর্ধেক। চাহিদা মেটাতে বছরে ১৭ লাখ লিটার তরল দুধের সমপরিমাণ গুঁড়া দুধ আমদানি হয়। দেশে দুগ্ধ খামার স্থাপনের অনেক সুযোগ রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও বেশ কিছু বাধার কারণে দুগ্ধ উৎপাদন বাড়ছে না। এসব বাধা দূর করলে দেশ দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে
‘সম্ভাবনাময় দুগ্ধশিল্প, আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে রোববার এ বৈঠক হয়। প্রথম আলো ও বেসরকারি সংস্থা কেয়ার আয়োজিত এ বৈঠকে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা ছাড়াও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা গুঁড়া দুধ আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর, দুধ শীতলীকরণ কারখানাগুলোতে সহজে বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়া এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ শিল্পের মতো বিদ্যুৎ বিল আদায় করা, গরু লালন-পালন ও যত্নের জন্য কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকবলের অভাব, খামার ও কারখানা স্থাপনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়া এবং গরুর উন্নত জাত উদ্ভাবনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সুযোগ না দেওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
বৈঠকের শুরুতে ও শেষে দেওয়া বক্তৃতায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ দুগ্ধশিল্পের সমস্যাগুলো সমাধানে মন্ত্রণালয় থেকে বড় পরিসরে আলোচনার জন্য বৈঠকের আয়োজন করবেন বলে জানান। দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আটটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই খাতের সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
সরকার গরুর জাত উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে পারে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের একার পক্ষে দেশের গবাদিপশু ও দুগ্ধশিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পোলট্রি শিল্প বেসরকারি খাতের হাত ধরে যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবে দুগ্ধশিল্পকেও এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আইনুল হক বলেন, ‘আমাদের দুধের উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তবে এখনো মাসে মাথাপিছু দুধ খাওয়ার পরিমাণ সোয়া লিটার। অথচ একজন মানুষের সাধারণ পুষ্টি চাহিদা মেটাতে মাসে কমপক্ষে আড়াই লিটার দুধ খাওয়া দরকার।’ দুধের উৎপাদন বাড়াতে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উৎপাদন বাড়াতে খামারিদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নে বড় একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেমি টার্জি বাংলাদেশের দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নে কেয়ারের কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মিলিন্ডা-গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে কেয়ার ২০০৭ সাল থেকে দেশের গবাদিপশু ও দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নে কাজ করছে। এসব কাজের সফলতা হিসেবে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত খামারিদের আয় বেড়েছে। সমবায়ের মাধ্যমে খামার স্থাপন, তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুধের মান নিয়ন্ত্রণ এবং ব্র্যাক ডেইরির মাধ্যমে ওই দুধ বাজারজাতকরণের ফলে আট জেলার ব্যবসায়ীদের আর্থসামাজিক উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে দুধের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারছে।
কেয়ার, বাংলাদেশের ইআরপিপির পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক বলেন, কেয়ার দেশের ৫২ হাজার খামারিকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিয়েছে। এতে তাঁদের খামারে গরুপ্রতি দৈনিক দুধের উৎপাদন দেড় থেকে বেড়ে সাড়ে চার লিটার হয়েছে। আয় ২৮ টাকা থেকে বেড়ে ১৪২ টাকা হয়েছে।
ব্র্যাক ডেইরি ও ফুড প্রজেক্টের মহাপরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, দেশে যে পরিমাণে দুধ উৎপাদিত হয়, তার মাত্র ৭ শতাংশ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বাজারে আসে। বাকি দুধ মাননিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বাজারে বিক্রি হয়। চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর আড়াই হাজার কোটি টাকার গুঁড়া দুধ আমদানি করতে হয়। গবাদিপশু ও দুগ্ধ উৎপাদন খাতকে সহায়তা দিলে চাহিদার পুরোটা দেশেই উৎপাদন সম্ভব। তিনি বলেন, দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) মান নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদন করে। কিন্তু সম্প্রতি খাদ্য পরিদর্শকেরা এসে দুধ পরীক্ষা করে বলছেন, নিরাপদ খাদ্য আইন অনুযায়ী ওই দুধ মানসম্পন্ন হয়নি। প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, তাহলে উৎপাদকেরা কোন আইন অনুযায়ী দুধের মান নিয়ন্ত্রণ করবেন?
মিল্ক ভিটার পরিচালক গোলাম মোস্তফা সারা দেশে মিল্ক ভিটার কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথমে গুঁড়া দুধের ওপর শুল্ক কমানো শুরু করেছিল। পরে ধারাবাহিকভাবে গুঁড়া দুধের ওপর থেকে শুল্ক কমেছে। এভাবে গুঁড়া দুধ আমদানিতে শুল্ক কমালে দেশে দুগ্ধশিল্প নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না।
এসিআই এগ্রিবিজনেসের নির্বাহী পরিচালক এফএইচ আনসারি বলেন, উন্নত জাতের মুরগি উৎপাদনের দায়িত্ব বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর এই খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু এখনো উন্নত জাতের গরু উৎপাদন ও আমদানি এককভাবে সরকারের হাতে। গবাদিপশু ও দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এ দায়িত্ব দিতে হবে।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের ডেইরি বিভাগের প্রধান মো. রাকিবুর রহমান বলেন, বেশির ভাগ খামারি কৃষক, সমবায় কোম্পানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে দুধ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো হয়। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানাগুলোতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সমপরিমাণ বিদ্যুৎ বিল নেওয়া হয়। এ ছাড়া একটি কারখানা স্থাপন করতে গেলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। তাই অনেকে আগ্রহ থাকলেও এই খাতে বিনিয়োগ করতে ভয় পান।
দুগ্ধ খামারি আম্বিয়া খাতুন অভিযোগ করেন, গবাদিপশু কেনার ক্ষেত্রে সরকার ৫ শতাংশ সুদে যে ঋণ দিচ্ছে, তা শুধু পুরুষদের দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ঋণ দেওয়ার জন্য জমির দলিল চায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জমির মালিক বাড়ির পুরুষ। ফলে নারীরা কাগজে-কলমে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও তা পান না।
কেয়ারের এসডিভিসি-২ প্রকল্পের দলনেতা মোস্তফা নূরুল ইসলাম বলেন, দেশে গবাদিপশু আছে প্রায় আড়াই কোটি। কিন্তু প্রাণী চিকিৎসক আছেন মাত্র আড়াই হাজার। গ্রাম পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও বেশি প্রাণী চিকিৎসক তৈরির জন্য সরকারের প্রতি সুপারিশ করেন তিনি।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বৈঠক সঞ্চালনার সময় বলেন, দুগ্ধশিল্পের যে সমস্যাগুলো আছে, তা কাটাতে হলে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব আন্তমন্ত্রণালয় সমস্যা আছে, তা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব নিয়ে ঠিক করতে হবে। বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বেসরকারি সংস্থা স্টেপ ওআরজির চেয়ারম্যান হাসান ইমাম ও কৃষি উৎসের মহাব্যবস্থাপক মারুফ আজম।
সুত্রঃ প্রথম আলো/ কৃপ্র/এম ইসলাম