কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে ভয়াবহ দুর্নীতি ধরা পড়েছে। ব্যাংকের ভল্টের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে পকেটস্থ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আবার যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ার পর সে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে কথিত ব্যবসায়ী। এমনকি সঞ্চয়পত্র জালিয়াতির মাধ্যমেও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কর্মকর্তারা। এছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া বেশির ভাগ ঋণই খেলাপি হচ্ছে। এতে করে ব্যাংকটির ঝুঁকিপূর্ণ খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। এর ফলে কৃষি ব্যাংকের বেশির ভাগ সূচক নেতিবাচক। আর্থিক মূল্যায়ন রেটিং ৫-এ নেমে এসেছে, যা সন্তোষজনক সীমার বহু নিচে। রয়েছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি। খবর দৈনিক যুগান্তর।
সম্প্রতি কৃষি ব্যাংকের ওপর করা বাংলাদেশ ব্যাংকের এক মূল্যায়ন ও পরিদর্শন প্রতিবেদন বিস্ময়কর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জড়িতদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয় ও কৃষি ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একটা ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার আগে যেসব মন্দ দিক থাকে, তার সবই কৃষি ব্যাংকে দেখা যাচ্ছে। এখন বাকি আছে শুধু ঘোষণা দেয়া। তিনি বলেন, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদসহ সব জায়গায় আমূল পরিবর্তন দরকার। ভেতরে-বাইরে কাজের পরিবেশ ফিরে না এলে এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা না গেলে কৃষি ব্যাংকের শেষ রক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
প্রতিবেদনের এক স্থানে বলা হয়, কৃষি ব্যাংকের ফেনী জেলার দাগনভূঞা থানার কুরাইশ মুন্সি বাজার শাখার কর্মকর্তারা ব্যাংকের ভল্টকে নিজের পকেট বানিয়েছে। ভল্ট থেকে টাকা নিয়ে খরচ করতেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম যখন পরিদর্শনে যায় তখন ভল্টের দরজা খোলা দেখতে পায়।
ভল্টের খতিয়ানে ২১ লাখ ৩৫ হাজার ৪২৭ টাকা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে গণনা করে পাওয়া যায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪২৭ টাকা। তাৎক্ষণিকভাবে সাড়ে ৬ লাখ টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার প্রমাণ মেলে। খোয়া যাওয়া এই টাকা উদ্ধারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদনের অপর এক স্থানে উল্লেখ করা হয়, কৃষি ব্যাংকের জুরাইন শাখা থেকে ন্যাশনাল ফুড প্রডাক্ট নামের এক প্রতিষ্ঠানকে ২০০৮ সালে ২০ লাখ টাকা সিসি ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু টাকা আদায় তো দূরের কথা প্রতিষ্ঠানটি লাপাত্তা হয়ে যায়।
চলতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম ঢাকার পূর্ব জুরাইনের ৫৮৩/১, ইসলামাবাদ রোডে ন্যাশনাল ফুড প্রডাক্টের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। বরং ওই স্থানে রয়েছে ভিআইপি ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের ভাষ্যমতে, ২ থেকে ৩ বছর আগে ঋণ নেয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম করে অন্য কোথায় চলে গেছে। যার হদিস কারও জানা নেই। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ২ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা বন্ধ করে চলে গেছে।
একইভাবে ব্যাংকটির মানিকগঞ্জ শাখার কর্মকর্তা পরিমল বিশ্বাস ব্যাংকের ভাউচার ও স্বাক্ষর জাল করে গ্রাহক সঞ্চয়পত্রের ৪৫ লাখ ৪ হাজার ৬০০ টাকা আত্মসাৎ করেন। এমন তথ্যও উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে। তিনি ১২টি ভাউচারের বিপরীতে ৩৩ লাখ ৪০ হাজার, ৫টি ভাউচারের বিপরীতে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০০ টাকা ও ৬টি ভাউচারের বিপরীতে তুলে নেন ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকটিতে এরকম ভয়াবহ অনিয়ম দুর্নীতি জেঁকে বসায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৪১ কোটি টাকায়। এর মধ্যে আদায় অনিশ্চিত বা ঝুঁকিপূর্ণ খেলাপি রয়েছে ৪ হাজার ৩১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বিতরণের প্রায় ২৩ শতাংশ। খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখার কথা ৪ হাজার ৭০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংক রেখেছে ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৬৩ কোটি টাকা।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের অনেকে বলেন, দুর্নীতিবাজরা যেভাবে এ ব্যাংকটিকে ঘিরে ফেলেছে তাতে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা ভুর্তকি দেয়া না হলে অনেক আগেই কৃষি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেত।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ ইসমাইল বলেন, কৃষি ব্যাংকের আজকের পরিস্থিতির জন্য সরকার ও কিছু মানুষ দায়ী। কারণ অনেক মানুষ মনে করেন সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নিলে আর ফেরত দিতে হয় না। আর সরকারের কাছে ব্যাংকের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আটকে আছে। সে টাকা দীর্ঘদিন চাওয়ার পরও দিচ্ছে না।
এছাড়া অনেক সময় সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে ছাড় দিচ্ছে। লোকসানের দায়ভার আসছে ব্যাংকের কাঁধে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে মূলধন ঘাটতি বাড়ে। তাছাড়া চলতি বছরে ৭১৬ জন কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। একসঙ্গে এদের অনেক টাকা দিতে হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, লোকবল সংকটে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। পুরনো লোকজন দিয়ে ব্যাংক চালাতে হচ্ছে। যাদের অনেকে কম্পিউটার চালাতে জানেন না। নতুন নিয়োগও দিচ্ছে না সরকার।
দুর্নীতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ নিয়ে কোনো ছাড় দেয়া হয় না। প্রমাণ হওয়ায় অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছি। বর্তমানে যেসব অনিয়মের কথা উঠে এসেছে, তা প্রমাণ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। অবশ্য এসব অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করার দায়িত্বে থাকা অডিট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মাহমুদ হাসান যুগান্তরকে বলেন, না দেখে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। এছাড়া ব্যাংকের একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। কৃষি ব্যাংকের ঋণ এখন রাজনৈতিক ঋণে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রার একটা চাপ থাকে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনেক সময় যাকে তাকে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অনিয়ম তো আছেই। তার মতে, ব্যাংকটি তার লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে। কৃষকের ব্যাংক ও কৃষি ঋণ বলা হলেও অনেক ঋণ ভিন্ন খাতে যাচ্ছে। বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করেন তিনি।
কৃপ্র/ এম ইসলাম