এসএম মুকুল: পাহাড়ে মিশ্র ফল বাগান সৃজনে বিপ্লবপার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৪-১৫ মৌসুমে ৯৭ হাজার ৬৮৪ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৫৩০ টন ফল। ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৯৭ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৬ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে এক লাখ ৪৬৬ টন। পার্বত্য চট্টগ্রামে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে তিন পার্বত্য জেলার ৬০০ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ মজাদার ফল কমলা ও মাল্টার চাষ হচ্ছেপ্রকৃতিগতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলো উর্বর ও অনেক প্রকার ফসল উৎপাদনের উপযোগী। একটা সময় ছিল পাহাড়ে জুমচাষ ছাড়া অন্য কোনো আবাদ হতো না। পাহাড়িরাও তাদের এই ঐতিহ্যবাহী ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকে আধুনিক চাষাবাদের প্রতি মনোযোগীও ছিল না। তবে জুমচাষ সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর হওয়ায় অধিক খরা বা বৃষ্টিতে উৎপাদন ব্যাহত হতো। এতে খাদ্যাভাবও দেখা দিত। এখন বিকল্প হিসেবে ফলের চাষ পাল্টে দিয়েছে পাহাড়ের অর্থনীতির চিত্র।
পাহাড়ে উৎপাদিত প্রচলিত ফল আনারস, কাঁঠাল, কলা, পেঁপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কমলা ও মাল্টা। পাহাড়ে উৎপাদিত টক-মিষ্টি স্বাদের ফল এখন পাহাড়ের সীমানা পেরিয়ে সারাদেশে পাওয়া যাচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন পাহাড়ের চাষিরা। জানা গেছে, গত মৌসুমে পাহাড়াঞ্চলে ১৭ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদিত হয় যা গত এক দশকে পার্বত্য জেলায় ফল উৎপাদনের নতুন রেকর্ড। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৪-১৫ মৌসুমে ৯৭ হাজার ৬৮৪ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৫৩০ টন ফল। ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৯৭ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৬ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৪৬৬ টন। পার্বত্য চট্টগ্রামে দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে তিন পার্বত্য জেলার ৬০০ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় সরকার। ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সাল মাত্র ১৮ বছরের ব্যবধানে পাহাড়ে মিশ্র ফল চাষ, বিশেষত আম, কমলা ও মাল্টা চাষ করে বহু পরিবার স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
পাহাড়ে সুস্বাদু কমলা ও মাল্টা
ফরমালিন ভরা ভিনদেশি হলুদ কমলা ও মাল্টার দিকে চেয়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ মজাদার ফল কমলা ও মাল্টা এখন পাহাড়ে পাহাড়ে চাষ হচ্ছে। পাহাড়ের সাফল্য দেখে সমতলেও কমলা ও মাল্টা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। জানা গেছে, পর্যটন মৌসুমে পাহাড়ি জেলাগুলোতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ এসব কমলা ও মাল্টা বাগান। ২০১১ সালে খাগড়াছড়ি সদর, রামগড় ও রাঙামাটির রাইখালির তিন স্টেশনে গবেষণার পর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) পাহাড়ের পাশাপাশি সমতলে কমলা ও মাল্টা উৎপাদনের জন্য কয়েকটি জাতের অনুমোদন দেয়। সেই থেকে বাড়ছে দেশজুড়ে সবুজ কমলা ও মাল্টার চাষ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কমলা ও মাল্টা গাছ বাঁচে ১৫ থেকে ২০ বছর। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ফুল আসে। আর ফল সংগ্রহের মৌসুম অক্টোবরের প্রথম পর্যন্ত। এক মৌসুমে প্রতি গাছে নূ্যনতম ২৫০-৩০০ পর্যন্ত ফল ধরে। পাহাড়ের মাটি ফসল চাষে উপযোগী হওয়া এবং ঝুঁকি না থাকায় প্রতিটি টিলায় বাগান গড়ে উঠেছে কমলা ও মাল্টা বাগান।
স্বাদে গন্ধে অনন্য পাহাড়ি আনারস
খাগড়াছড়ির উঁচুঁ-নিচুু সবুুুুজ পাহাড়ে ঘেরা। এ সবুজ অরণ্যের নির্ঝণে বসবাসকারী কৃষকরা রসালো ফল আনারস চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। যে দিকেই চোখ যায় সেখানেই আনারসের ক্ষেত। এ যেন সবুজ পাহাড়ে কাঁটাযুক্ত আনারসের বাহারি বাগান। সদর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার ৫ শতাধিক কৃষক ১৪৪ হেক্টর জমিতে আনারসের বাগান গড়ে তুলেছেন, কারণ আনারস চাষে ঝুঁকি নেই। এ ছাড়া মাটিরাঙা, দীঘিনালা, পানছড়ি ও রামগড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আনারস হয়ে থাকে। একবার লাগালে দুই বছর ফলন পাওয়া যায়। আনারস বিক্রি শেষে চারাও বিক্রি করা যায়।
শেরপুরে বাউকুল
এ ছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে শীত মৌসুমের সুস্বাদু ফল ‘বাউকুল’ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। প্রায় ২৬ একর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত বাউকুল বিক্রি করে কৃষকরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি শতাধিক দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ঝিনাইগাতী উপজেলায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৫০টি বাগানে বাউকুল ও আপেলকুল চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে গারো পাহাড়ে বাউকুল আবাদের ধুম পড়ে গেছে। পতিত জমিতে বাউকুল আবাদে এগিয়ে এসেছেন অনেকে। আর বাউকুল গাছ থাকায় বন্য হাতির আক্রমণও কমে গেছে।
কফি চাষে উজ্জ্বল সম্ভাবনা
পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি ঢালু জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় প্রায় ৩০০ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ হচ্ছে। বর্তমানে এ এলাকায় ১ লাখ ৮০টি কফির গাছ রয়েছে। এতে প্রায় ২ হাজার কেজি কফি উৎপন্ন হবে বলে চাষিরা আশা করেছেন। এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণ কফি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এখানে চায়ের মতো কফি চাষের সম্ভাবনা প্রচুর। তিনি বলেন, বাগানে কফির ফুল আসে ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাসে এবং বীজ বা ফল পরিপক্ব হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে। কফির ফলন পাওয়া যায় বছরে এক বার। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বোর্ডের অর্থায়নে তিন পার্বত্য জেলায় কফি চাষকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে নয় বছরমেয়াদে কফি চাষ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও পানছড়ি, রাঙামাটি জেলার সাজেক ও বরকল এবং বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় প্রায় ৫০০টি কফি বাগান গড়ে উঠেছে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে কৃষকরা যাতে কফি বাজারজাতকরণ করতে পারে তার জন্য ঢাকার ম্যাক ফাউন্ডেশন পার্বত্যাঞ্চলের উৎপাদিত কফি সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরণের কাজ শুরু করেছে।
সবুজ পাহাড়ে লাল চেরি
কাপ্তাইয়ের সবুজ পাহাড়ে চেরি গাছের ডালে ডালে লাল চেরি ফল ধরেছে। কাপ্তাইয়ে চেরি ফল চাষে সহায়তা করছে রাইখালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। প্রায় সাড়ে তিন বছর গবেষণার পর চেরি ফল চাষে সফলতা পেয়েছেন তারা। জানা যায়, দেশ থেকে বিলুপ্তপ্রায় ৫২ প্রজাতির ফল সংরক্ষণ ও দেশব্যাপী চাষাবাদ আবার বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কাপ্তাইয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে একটি ফলের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। চেরি ফল যে কোনো ডেজার্টজাতীয় খাবারকে সুস্বাদু, দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করে। পোলাও, ফিরনি, পায়েশ, বিরিয়ানি ইত্যাদি রান্নায় চেরি ফল ব্যবহার করা হয়। বিলুপ্তপ্রায় চেরি ফলের চাষাবাদে পার্বত্য এলাকার মাটি উপযোগী। কাপ্তাই কৃষি গবেষণায় সাফল্যের ফলে পার্বত্য এলাকাগুলোয় এ ফলের চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে কৃষি কর্মকর্তারা মনে করেন।
লেবু চাষে শ্রম কম
খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দারবান ছাড়াও হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকাগুলোয় লেবু চাষে কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছেন। তুলনামূলক কম শ্রমে লাগে বিধায় এসব জেলার পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় লেবু বাগান। এ অঞ্চলের উৎপাদিত লেবু শুধু দেশেই নয়, ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হচ্ছে। হবিগঞ্জ জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১৪০০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হচ্ছে। বছরে জেলায় প্রায় আট হাজার মেট্রিক টন লেবু উৎপাদন হয়। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতের লেবু হচ্ছে_ জারা, কাগজি ও কলোম্ব।
জনপ্রিয় হচ্ছে মিশ্র ফলচাষ
জুমচাষ প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং লাভ কম হওয়ায় পাহাড়িরা মিশ্র ফলচাষে ঝুঁকছেন। কৃষি জমির স্বল্পতা পাহাড়িরা এক জায়গায় কোনো ফলের চারা রোপণ করলে আর ফসল বা ফলচাষ করতে পারতেন না। এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র মিশ্র ফল চাষাবাদ পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। পাহাড়ে মিশ্র ফলের চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। দেখা গেছে, শুধু আমবাগান করলে চার-পাঁচ বছর পর ফল পাওয়া যায়, কিন্তু জমি আর ব্যবহার করা যায় না। একারণে একই জমিতে পর্যায়ক্রমে আনারস, এরপর লেবু, পেয়ারা, লিচু, আম, কাঁঠাল লাগালে লাভবান হওয়া যায়। পাহাড়ের উপযোগী আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, পেয়ারা, লেবু, আনারস, কাজু বাদাম, কফি, ড্রাগন ফল, মাল্টাসহ নানা ফল নিয়ে গবেষণা করছে বারির পাহাড় অঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলো।
লেখক : কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
কৃপ্র/ এম ইসলাম