বিজ্ঞানি ড. কে, এম, খালেকুজ্জামানঃ পান একটি অর্থকারী ফসল। আমাদের দেশে পানের বরজ খুব বেশী দেখা না গেলেও এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। দেশে বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। এতে অনেক ঔষধি গুণ বিদ্যমান। কিন্ত রোগ বালাই পান উৎপাদনের একটি প্রধান অন্তরায়। পানে গোড়া পঁচা, ঢলে পড়া, পাতা পঁচা, অ্যানথ্রাকনোজ, সাদা গুড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এই রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। তাই পানের কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
১। রোগের নামঃ কান্ড পঁচা/গোড়া পঁচা
রোগের কারণঃ স্কেরোসিয়াম রফসি নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তারঃ ছত্রাক গুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে। মাটিতে জৈব সার বেশী ও খড়কুটা থাকলে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ্য ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণঃ
১. গাছের যে কোন বয়সে এ রোগ হতে পারে।
২. গ্রীষ্মকালে মাটির উপর শায়িত লতায় এই রোগ হয়।
৩. গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গোড়ায় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মাটির কাছের একটি বা দু’টি পর্বমধ্য কালো বর্ণ ধারণ করেছে।
৪. উপরে লতার পাতা হলুদ হয়ে যায় ও ঝড়ে পড়ে।
৫. মাটি সংলগ্ন লতার উপর সাদা সুতার ন্যায় ছত্রাক মাইসেলিয়া দেখা যায়।
৬. পরে হালকা বাদামী থেকে বাদামী সরিষার ন্যায় এক প্রকার অসংখ্য দানার মত স্কেরোাসিয়া দেখা যায়।
৭. মাটি সংলগ্ন ডাঁটা পঁচে যায় এবং গাছ ঢলে পড়ে মরে যায়।
রোগের প্রতিকারঃ
১. রোগাক্রান্ত লতা/পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
২. রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে।
৩. গভীর ভাবে জমি চাষ দিয়ে রোদে ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে।
৪. নতুন বরজ তৈরীর ক্ষেত্রে সুস্থ্য সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
৫. পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৬. ট্রাইকোডারমা কমপোস্ট সার প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
৭. লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভে* বা ব্যভিষ্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে।
৮. বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভে* বা ব্যভিষ্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
২। রোগের নামঃ শিকড় পঁচা
রোগের কারণঃ রাইজোকটোনিয়া সোলানী (জযরুড়পঃড়হরধ ংড়ষধহর) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তারঃ মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণঃ
১. গাছের শিকড়সহ মাটির নীচের সমস্ত অংশই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
২. প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে।
৩. পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়।
৪. এই অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙ্গে ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার :
১. সম্ভব হলে মাটি শোধন করতে হবে।
২. রোগাক্রান্ত লতা/পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
৩. রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে।
৪. নতুন বরজ তৈরীর ক্ষেত্রে সুস্থ্য সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
৫. পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৬. লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভে* বা ব্যভিষ্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে।
৭. বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভে* বা ব্যভিষ্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৩। রোগের নামঃ ঢলে পড়া
রোগের কারণঃ ফিউজারিয়াম অক্সিস্পোরাম নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তারঃ ছত্রাক গুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ্য ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণঃ
১. গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে।
২. গাছের উপরের পাতা হলুদ হয়ে যায়।
৩. কান্ডের ভাস্কুলার টিস্যু আক্রমণ করে। গোড়ার দিকে কান্ড লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভিতরে দাগ দেখা যায়।
৪. পরে গাছ ঢলে পড়ে।
৫. আক্রমণ বেশী হলে গাছ মরে যায়।
রোগের প্রতিকারঃ
১. রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. গাছের গোড়ার চতুর্দিকের পৃষ্ঠের মাটি নেড়ে শুষ্ক করে দিলে এ রোগ অনেকাংশে দমন হয়।
৩. লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভে* বা ব্যভিষ্টিন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে।
৪. রোগ দেখা দিলে প্রোভে* বা ব্যভিষ্টিন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৪। রোগের নামঃ গোড়া/লতা ও পাতা পচাঁ
রোগের কারণঃ ফাইটোফথোরা প্যারাসাইটিকা নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তারঃ কম ম্যাগনেসিয়াম ও বেশী লবণাক্ত মাটিতে রোগের প্রকোপ বেশী। অবিরত বৃষ্টিপাত হলে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণঃ
১. প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় পানি ভেজা হলুদাভ বাদামী রংয়ের দাগ দেখা যায়।
২. ধীরে ধীরে দাগ বিস্তৃত হয়ে বড় হতে থাকে।
৩. দাগ পাতার কিনারা হতেও শুরু হতে পারে।
৪. অবিরত বৃষ্টিপাত স্থলে রোগটি পাতা হতে বোঁটায় এবং লতায় সংক্রমিত হয়।
৫. আক্রান্ত পাতা ও লতায় এক প্রকার কালো দাগ পড়ে। ঐ দাগের মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে পঁচে যায়।
৬. আক্রান্ত পাতা ঝরে পড়ে।
৭. পরে গাছের শিকড়, লতা ও পাতা পঁচে এক প্রকার দুর্গন্ধ নির্গত করে।
৮. আক্রমণ বেশী হলে গাছ মারা যায়।
রোগের প্রতিকারঃ
১. রোগাক্রান্ত গাছের পাতা তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
২. রোগমুক্ত লতা বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
৩. রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-২ চাষ করতে হবে।
৪. ঘন ঘন সেচ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. ট্রাইকোডার্মা জীবাণু সার ৫ গ্রাম হারে প্রতি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
৬. বরজে রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড অথবা কমপেনিয়ন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ সমস্ত গাছে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৫। রোগের নামঃ তবা পাতার দাগ
রোগের কারণঃ কোলেটোট্রিকাম পাইপারিস নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তারঃ বাতাসে আর্দ্রতা বেশী থাকলে দ্রুত রোগ বাড়ে।
রোগের লক্ষণঃ
১. প্রথমে পাতায় বিপ্তিভাবে ছোট ছোট ফোস্কার মত অসম দাগ পড়ে।
২. দাগগুলো কিনারা থেকে ভিতরের দিকেই বেশি দেখা যায় ।
৩. দাগগুলি হালকা বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী হয় এবং চারিদিকে হলুদ বর্ণের হয়।
৪. দাগগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে। অনেক গুলো দাগ এক সঙ্গে মিলিত হয়ে বড় দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি করে।
৫. পরে প্রতিটি দাগের মাঝখানে কালো ও চারিপাশে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
৬. দাগগুলির মাঝখানটা শুকিয়ে যায় এবং সমগ্র পাতা নষ্ট হয়ে পড়ে।
৭. বেশী দাগ হলে পাতা খসে পড়ে।
রোগের প্রতিকারঃ
১. রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ হতে তুলে পুড়ে করতে হবে।
২. নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা রোপণ করতে হবে ।
৩. রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-১ ও বারি পান-২ চাষ করতে হবে।
৪. বরজে রোগ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৬। রোগের নামঃ সাদা গুড়া
রোগের কারণঃ অয়িডিয়াম পাইপারিস
রোগের বিস্তারঃ গরম ও শুস্ক আবহাওয়া এবং ৫০-৬০% বাতাসের আর্দ্রতায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ।
রোগের লক্ষণঃ
১. পাতার নীচের পিঠ সাদা থেকে হালকা বাদামী গোলাকৃতি পাউডার লাগানো দাগ পড়ে। পরে দুই পিঠেই দাগ হয়।
২. দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
৩. দাগ পড়া এলাকাটি পরে বাদামী রংগের হয়, শুকনো ও ভংগুর হয়।
৪. কচি পাতা আক্রান্ত হলে সে পাতা আর বাড়ে না এবং বিকৃত হয়ে যায়।
৫. আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ে।
৬. লতার বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।
রোগের প্রতিকারঃ
১. রোগমুক্ত গাছ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে।
২. ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ এবং আর্বজনা পুড়ে ফেলতে হবে।
৩. দ্রুতবেগে পানি স্প্রে করলেও রোগের প্রকোপ কমে যায়।
৪. রোগ দেখা দিলে থিউভিট ৮০ ঢ়ি অথবা কুমুলাস ডিএফ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৫. রোগের আক্রমণ বেশী হলে প্রতি লিটার পানিতে ব্যভিষ্টিন ১ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
লেখকঃ উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব), মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই , শিবগঞ্জ, বগুড়া।
কৃপ্র/ এম ইসলাম