কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ মেথি ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় বহুবিদ ব্যবহার হয়। অনাদিকাল থেকে আমাদের দেশে মেথির প্রচলন আছে কিন্তু ব্যাপকতা বা বিস্তৃতি জনপ্রিয়তা তেমন ঘটেনি এ সাধারণ ফসলটির অসাধারণ গুণ। ইংরেজিতে একে Fenugreek বলা হয়। এ ফসলটির সাধারণ পরিচিতি কম হলেও এর অসাধারণ ভেষজ গুন, চাহিদা, ফলন এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত গুররুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে প্রধানত মেথির বীজ মসলা এবং ওষুধি ভেষজ হিসেবে চাষ করা হয়। মেথির বীজ মসলা হিসেবে রান্নার কাজে, আচার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এর অবশ্য উচ্চ ওষুধি গুণাগুণ ও শিল্পে ব্যবহার রয়েছে। মেথি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হজমে সহায়তা করে ক্ষুধা বাড়ায়, বহুমুত্র রোগে বেশ ফলদায়ক, মায়েরা নিয়মিত আর পরিমিত খেলে বাচ্চারা বেশি দুধ পায়। গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে পরিমিত এবং নিয়মমতো মেথি খেলে মায়েদের দুধ ৯০% পর্যন্ত বেড়ে যায়।
শিল্পক্ষেত্রে মেথি রঙ তৈরিতে ব্যহৃত হয় এবং মেথি থেকে এ্যালকালয়েড ও মুল্যবান স্টেরয়েড নিষ্কাশন করা হয়। এর কাচাপাতা শাক হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু। গ্রামবাংলায় মেথিশাক তাদের প্রিয়খাদ্য। আর শুকনোপাতা যাকে কাশুরি মেথি বলে এদের পাতা তিতা কিন্তু ঘ্রাণ আর বৈশিষ্ট্যের জন্য বিভিন্ন তরিতরকারি ও ব্যাঞ্জরিত রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এর গাছ গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়।
ভারতে মেথির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। আরব তথা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলেও মেথির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এশিয়ায় চুলের যত্নে, ত্বকের যত্নে, রূপলাবণ্য বাড়াতে এবং দই তৈরিতেও মেথি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ রুটি তৈরিতেও মেথির প্রচলন আছে কোথাও কোথাও। মিশরে মেথির চা বেশ জনপ্রিয়। উন্নত দেশের কফিহাইজে মেথি বেশ আহলাদি উপকরণ। ইহুদি সম্প্রদায় নতুন বছরের প্রথম বা দ্বিতীয় দিন মেথিকে বিশেষ উপকরণ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে খায় ও ব্যবহার করে।
পুষ্টিগুণ মেথি: প্রতি ১০০ গ্রাম মেথি বীজে ৬.৩ গ্রাম পানি, ৯.৫ গ্রাম আমিষ, ১০ গ্রাম ফ্যাট, ১৮.৫ গ্রাম আঁশ, ৪২.৩ গ্রাম শ্বেতসার, ১৩.৪ গ্রাম খনিজ, ১.৩ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৪৮ গ্রাম ফসফরাস, ০.০৯ গ্রাম লৌহ, ০.০৯ গ্রাম সোডিয়াম, ১.৭ গ্রাম পটাশিয়াম, ভিটামিন বি১ ৯.৪১ মিলিগ্রাম, বি২ ০.৩৬ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ৬.০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১২.০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ১০৪০ আইইউ এবং খাদ্যমান ৩৭০ কিলোক্যালরি থাকে। তাহলে পুষ্টি বিচারেও মেথি অনন্য ভুমিকার অধিকারি।
মেথিগাছ দ্রুত বর্ধনশীল, খাড়া, শাখান্বিত কান্ড বিশিষ্ট, ৪০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গোলাপী বা সবুজ কিনারাসহ এর গাঢ় সবুজ যৌগিক পাতা খুবই আকর্ষনীয়। ৩টি করে পাতা একসাথে জন্মায়। ফুলেও ৩টা করে পাপড়ি থাকে। কক্ষমুকুলের প্রতি থোকায় ২/৩ টি করে উজ্জলসাদা ও হলুদরঙের ফুল ফোটে। স্ত্রী ও পুরুষফুল আলাদাভাবে ফোটে। কাচির মতো বাঁকানো সরুফল বা পড ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। প্রথম দিকে ফলের রঙ হালকা সবুজ থাকলেও পাকলে তা খড়ের বর্ণ ধারণ করে
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানীয় জাতের মেথির আবাদ হয়ে থাকে। এমনিতে মেথির কোন সুনিদিষ্ট জাত নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র বারিমেথি-১ ও বারিমেথি-২ নামে দুটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। সাধারনভাবে দু’ধরণের মেথির চাষাবাদ হয়। দ্রুতবর্ধনশীল সাধারণ মেথি হলুদবীজ সাদাফুল এবং ধীর বর্ধনশীল কেশুরি জাতের মেথি যা উজ্জ্বল কমলা বা হলুদ বর্ণের ফুল উৎপাদন করে। সব ধরণের মাটিতেই মেথি জন্মানো যায়, দোআঁশ মাটিতে মেথি বেষি ভালো হয়। তদুপরি জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ এঁটেল দোআঁশ জমি মেথি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। জমির অম্লমান ৬ থেকে ৭ এর মধ্য হলে মেথি ভালো হয়।
আমাদের দেশে মেথি রবি ফসল। বাংলাদেশের শীতের শুরুতে মেথি বীজ বোনা হয়ে থাকে। সাধারণ মেথি প্রতিহেক্টর জমির জন্য ২৫ কেজি এবং কেশুরী জাতের ২০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর অর্থ্যাৎ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত মেথি বোনার সবচেয়ে ভালো সময়। সাধারণত মেথি বীজ বপণ থেকে ৫/৬ দিনে গজায়। তবে বেশি শীত পড়লে সময় একটু বেশি লাগতে পারে। মেথির বীজ আকারে ছোট হওয়ার জমি খুব ভালো ভাবে প্রস্তত করা দরকার।
মেথি বীজ ছিটিয়ে বপণ করা হয় । তবে ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইন করে বপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত মেথি চাষের জন্য পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্ট সারের ওপর নির্ভর করা হয়ে থাকে। তবে পাতা বা শাক উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে নাইট্রোজেন এবং পটাশ সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। বীজ উৎপাদনের জন্য প্রতিশতকে যে পরিমাণ সার দেওয়া যেতে পারে তাহলো কম্পোস্ট বা জৈবসার ৬০ কেজি, ইউরিয়া ৭০০ গ্রাম, টিএসপি ৭০০ গ্রাম, এমওপি ৫৫০ গ্রাম, জিপসপম ৪৫০ গ্রাম। সব জৈবসার, টিএসপি, এমওপি ও ৩ ভাগের ১ ভাগ ইউরিয়া শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। বাকী ইউরিয়া বপনের ৩০ ও ৪৫ দিন পর আগাছা দমনের পর উপরি প্রয়োগ করতে হয়।
মেথি বীজ বপনের ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পরে শাক সংগ্রহ করা যায়। ১/২ বার শাক সংগ্রহের পর বীজ উৎপাদনের জন্য রেখে দেওয়া যায়। বীজ এর জন্য মেথির ফলগুলি হালকা হলুদ বা গোড়ার গুলি খড়ের মত রঙ ধারণ করলে গাছের গোড়া কেটে সংগ্রহ করা ভালো। সকালে বা বিকেরে মেথি তুলতে হয়। ভর দুপুরে মেথি না তোলা ভালো। সম্পূর্ন গাছ উপড়িয়ে সংগ্রহ করলে শিকড়ে লেগে থাকা মাটি বীজ এর গুণগত মান কমিয়ে দেয় এবং জমিতে জৈবপদার্থ কমযোগ হয়। সংগৃহীত গাছগুলি ২/৩ দিন গাদা করে রেখে রোদে ভালো ভাবে শুকিয়ে সাবধানতার সাথে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করা যাবে।
বারি মেথি-১ ও বারি মেথি-২ ভালোভাবে আবাদ করে যথাক্রমে হেক্টর প্রতি ১.২ থেকে ১.৫ ও ১ থেকে ১.৫ মেট্রিকটন বীজ পাওয়া যেতে পারে। শাক হিসেবে চাষ করলে সাধারণ জাতে ৫ থেকে ৭ মেট্রিকটন এবং কেশুরি জাতের থেকে থেকে ১০ মেট্রিকটন শাক পাওয়া যেতে পারে।
যদিও আমাদের দেশে মেথির উৎপাদন, ব্যবহার ও আমদানির সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই তবুও ধারণা করা যায় যে এক্ষেত্রে আমরা স্ব^নির্ভর নই। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন নেহায়েত কম না। আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানো ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য মেথির চাষ বাড়ানো দরকার বিশেষভাবে। এককভাবে বা সাথীফসল হিসেবে আখ, ভূট্টা, রসুন বা পিঁয়াজের সাথে বা পিঁয়াজের চারা উৎপাদনের সময় রিলে ফসল হিসেবে চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। অন্য ফসলের সাথে বা পারিবারিক বাগানে মেথির আবাদ করে নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রি করে অর্থোপার্জনও করা যায়।
কৃপ্র/এম ইসলাম