কৃষি প্রতিক্ষণ রিপোর্টঃ তিনভাগ জল আর এক ভাগ স্থল এটাই বাস্তবতা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বরিশাল এখানে পানি আর পানি অথই পানি। বছরের ৬/৭ মাস পানি বন্দী থাকে অনেক এলাকা।ভাসমান এ পদ্ধতিকে বরিশালের স্থানীয় ভাষায় বলে ধাপপদ্ধতি। অনাদিকাল থেকে শুরু এ ভাসমান চাষাবাদ। কেউ জানে না কখন থেকে শুরু এ ধাপপদ্ধতির চাষাবাদ। সারাবছর নিচু জমিতে জোয়ার ভাটার কারণে জমিতে পানি থাকার কারণে তারা চাষাবাদ করতে পারত না।
কুচুরিপানা পানিতে ভেসে থাকতো প্রায় বছরব্যাপি। কুচুরিপানাকে তারা ধাপে ধাপে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে। তারপর সেসব ধাপের উপর টোপাপানা দিয়ে তারা তৈরি করে ভাসমান বীজতলা। ভাসমান বীজতলার চারাগুলোর কোনটা পেঁপে, লাউ, শিম,বরবটি আবার অন্যগুলো টমেটু, বেগুন, করলার চারা এসব। এসব ভাসমান বীজতলাগুলো যাতে ভেসে না যায়, সেজন্য তারা শক্ত বাঁশের খুটির সাহায্যে বেঁধে রাখে।
শুকনো মৌসুমে পানি সরে গেলে সেসব কুচুরিপানার ধাপ নিচু জমিতে জৈব পদার্থের যোগান দেয়। শুকনো মৌসুমে এখানকার মানুষরা চাষ করে বোরো ফসল। এতদিন তারা ভাসমান বীজতলায় কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করতোনা। তবে বর্তমানে তারা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরার্মশে স্বল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন।
পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজারে পাশে মুগারঝোরা গ্রাম ভাসমান চাষাবাদে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। সেখানে পুরুষ ও মহিলাদের সম্মিলিত বিনিয়োগে সৃষ্টি হচ্ছে দেশের এক প্রতিশ্রুতি ইতিহাস আর সমৃদ্ধির হাতছানি। সেখানে মহিলারা দুলালি লতা দিয়ে মেডা তৈরি করছে। স্থানীয় ভাষায় এ মেডা হচ্ছে টোপাপানা দিয়ে গোলাকার বস্তু। স্থানীয় ভাষায় একে বলে দৌলা। যার মধ্যে একটা বাঁশের কাঠির সাহায্যে ২টি গজানো বিভিন্ন ধরনের সবজি বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
দিনে একজন মহিলা প্রায় ১ থেকে দেড়হাজারটি দৌলা তৈরি করতে পারে। এসব দৌলা উঁচু কোন জায়গায় কিছুদিন রেখে ২ পাতার চারা হলে তাকে ভাসমান বেড বা ধাপে স্থানান্তর করা হয়। স্থানীয় ভাষায় ভাসমান বেডে চাষ না বলে বলা হয় ধাপচাষ।
আর এ ভাসমান বেড বা ধাপ তৈরি করার পদ্ধতি হলো-ভাসমান কুচুরিপানা সংগ্রহ করে প্রায় ১৫০ ফুট বেড তৈরি করা হয়। তারপর কমপক্ষে ২০ ইঞ্চি উঁচু করার জন্য কুচুরিপানার স্তর একের পর এক সাজানো হয়। এরপর দেয়া হয় প্রথমে টোপা পানা তারপর দুলালী লতা। মোটামুটি ২০ ইঞ্চি পরিমাণ উচু হলে তার উপর দৌলাগুলোকে সুন্দরভাবে সারিতে সাজানো হয়। দেখলে তখন অনিন্দ্য সবুজসুন্দর ভুবন মনে হয়। তারপর ধাপের নিচ থেকে টেনে এনে নরম কুচুরিপানাগুলো দৌলার গোড়ায় দিয়ে দেওয়া হয়। এতে দৌলাগুলো একে অপরের সাথে গায়ে গায়ে লেগে থাকে।
এরমধ্যে পড়ে প্রতিদিন ধাপে হালকা করে পানি সেচ দেওয়া। যাতে করে চারার গোড়া শুকিয়ে না যায়, সজীব থাকে। আর অল্প পরিমাণ ইউরিয়া সার ছিটানো। এভাবে মাসাধিক কাল যত্ন শেষে বিক্রির জন্য তৈরি হয়। বীজতলার মালিকরা অপেক্ষা করেণ মহাজন ফড়িয়ার জন্য। ক্রেতারা ণৌকায় এখানে আসেন এবং কিনে নিয়ে যান। জোয়াভাটায় বহমান গ্রামীণ এ জনপদে এ আয় অনেক বেশি আশার আলো।
প্রকৃতির সাথে সংগ্রামরত মানুষের এভাবে বেঁচে থাকার উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণঞ্চলের নাজিরপুর আর বানারীপাড়ার বাস্তবতা। পানি বন্দী বা ২ লাখ হেক্টর জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের। বাঁচতে শেখার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করতে পারে এ জ্বলন্ত প্রমাণ। জরিপ বলে এরকম আরো হাজার জমিকে খুব সহজেই ভাসমান চাষের আওতায় আনা সম্ভব।
কৃপ্র/ এম ইসলাম