কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ লেবু আমাদের বাংলাদেশের মানুষের একটি অন্যতম সহায়ক সবজি। খাবার টেবিলে এবং সালাদে লেবু থাকা চাই। লেবুর স্বাদ বৃদ্ধির ভূমিকা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে খাদ্যগুণ। পাতি লেবুকে ভিটামিন ‘সি’ এর ডিপো বলা হয়। লেবু এক আশ্চর্য গুণসম্পন্ন সবজি এবং ভেষজ। ভিটামিন ’সি’ সমৃদ্ধ ফলের মধ্যে লেবুই একমাত্র ফল যা সারা বছর কম বেশি পাওয়া যায়। লেবুর রস মধু বা আদা বা লবণ এর সাথে মিশিয়ে পান করলে ঠাণ্ডা ও সর্দি কাশি উপশম হয়।
উপযুক্ত জমি ও মাটি : হালকা দোআঁশ ও নিকাশ সম্পন্ন মধ্যম অম্লীয় মাটিতে লেবু ভাল হয়।
জাত পরিচিতি:
বারি লেবু-১ (এলাচী লেবু):উচ্চ ফলনশীল লেবু বারি লেবু-১। ঘ্রাণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।গাছ আকারে বড়।পাতা বড় ও প্রশস্ত। পরিচর্যা পেলে গাছ বছরে দু’বার ফল দেয়।জুলাই-আগস্ট মাসে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়।পূর্ণবয়স্ক গাছ ১৫০ টি পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে।আকারে বড়,ডিম্বাকৃতি এবং প্রতিটি ফলের গড় ওজন ১৯৫ থেকে ২৬০ গ্রাম।বৃহত্তর সিলেট এবং আরও অনেক এলাকায় এলাচী লেবুর খোসা খাওয়া হয়।
বারি লেবু-২: বারি লেবু-২ উচ্চ ফলনশীল জাত।মধ্যম আকৃতির ও ঝোপের মতো গাছ।সারা বছর প্রচুর ফল দেয়।ফল গোলাকার,মধ্যম ওজনের। ত্বক মসৃণ এবং বীজের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এই লেবু সারা দেশেই চাষাবাদের উপযোগী।
বারি লেবু-৩: একটি দেরীতে হওয়া (নাবি)জাত বারি লেবু-৩।গাছ ও পাতা ছোট আকৃতির।ফল গোলাকার ও ছোট। ত্বক খুবই মসৃণ,খোসা পাতলা এবং বীজের সংখ্যাও কম ১৮-২২টি।রসের পরিমাণ খুব বেশি (৩৭.৭%)।সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়।সার ও পানির ব্যবস্থা করলে বছরে দু’বার ফল পাওয়া যায়।সারা দেশেই চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
চারা রোপণ: গুটি কলম ও কাটিং তৈরি করে মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আশ্বিন মাসে ২.৫ মিটার দূরে দূরে রোপণ করা হয়।মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য আশ্বিন মাস চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত।
সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গাছে টিএসপি সার ৪০০ গ্রাম,এমওপি সার ৪০০ গ্রাম,ইউরিয়া সার ৫০০ গ্রাম ও গোবর ১৫ কেজি প্রয়োগ করতে হয়।সার তিনভাগে যার প্রথম কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে,২য় কিস্তি মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন মাসে এবং৩য় কিস্তি মধ্য জৈষ্ঠ্য থেকে মধ্য আষাঢ় মাসে প্রয়োগ করতে হয়।
অঙ্গ ছাঁটাই: প্রতি বছর মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে গাছের অবাঞ্ছিত শাখা ছাঁটাই করতে হয়।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা: খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দেয়া দরকার।পানি যাতে না জমে থাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা
পোকার নাম: লেবুর প্রজাপতি পোকা
ক্ষতির নমুনা: এ পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খেতে শুরু করে এবং সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে।
ব্যবস্থাপনা: ডিম ও কীড়াযুক্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নীচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হয়।আক্রমণ বেশি হলে ডাইমেক্রন ১০০ ইসি ১ মি.লি অথবা সেভিন ৮৫ এসপি ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর সেপ্র করতে হয়।
পোকার নাম:লেবুর লাল ক্ষুদ্র মাকড়
ক্ষতির নমুনা: মাইট লেবু গাছের পাতা ও ফলের সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে।ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ফলের গায়ে সাদা আবরণ দেখা যায়।পাতার নীচের দিকে লক্ষ্য করলে ক্ষুদ্র মাইট চলাচল করতে দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা: মাকড় সহ আক্রান্ত পাতা তুলে ধ্বংস করা।আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মি.লি ইথিয়ন ৪৬.৫ তরল বা নিউরণ ৫০০ তরল মিশিয়ে লেবুর পাতা ভিজিয়ে সেপ্র করা।
ফসল তোলা:ফল পূর্নতা প্রাপ্তি হলে সবুজ থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে।
লেবুর জাতঃ লেবুর অনেক জাত আছে।তন্মধ্যে পাতিলেবু, কাগজিলেবু, এলাচিলেবু, সিডলেসলেবু, সরবতিলেবু, বাতাবিলেবু,কমলালেবু ও মাল্টালেবু উল্লেখযোগ্য।তবে কমলালেবু পাহাড়ি এলাকায় জন্মে।বাকিগুলো সমভূমিতেই জন্মে।
কিভাবে চারা লাগাবেনঃ দুইভাগ দোঁ-আশ বা বেলে দোঁ-আশ মাটির সংগে একভাগ গোবর মিশাতে হবে।একটি বার ইঞ্চি টবের জন্য ৫০গ্রাম টি,এস,পি, ৫০গ্রাম পটাশ, ১০গ্রাম চুন এবং ১৫০গ্রাম হাড়ের গুড়া একত্রে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে ১২-১৫ দিন।অতঃপর একটি লেবুর কলমের চারা ঐ টবে রোপন করতে হবে।লেবুতে সাধারণত ডাইব্যাক নামক এক ধরনের রোগ দেখা যায়।তাই কলমের চারাটি যাতে রোগাক্রান্ত না থাকে তা দেখে নিতে হবে। লেবু জাতীয় সকল গাছেই সাধারণত পানি খুব কম প্রয়োজন হয়।চারা লাগানোর প্রথমদিকে পানি আরও কম দিতে হয়।
পরিচর্যাঃ চারা লাগানোর পর প্রথম ২-৩ মাস পানি দেওয়া এবং আগাছা পরিষ্কার করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে হবেনা।গাছ একটু বড় হলে ২০ দিন অন্তর অন্তর সরিষার খৈল পঁচা পানি হালকা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে লেবু গাছে ফল ধরবে।বর্ষা আসার পূর্বে সাতদিন অন্তর অন্তর কয়েকবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে ভাল হয়।এছাড়াও বছরে তিন থেকে চারবার কোন ভাল কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।তবে লেবু গাছে ফুল থাকা অবস্থাতে কীটনাশক স্প্রে না করাই ভাল।গাছ লাগানোর দুই বছর পর থেকে প্রতি বছর বর্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে টবের গাঁ ঘেঁষে দুই ইঞ্চি পরিমান প্রস্থে এবং ছয় থেকে আট ইঞ্চি গভীর করে মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিতে হবে।আমাদের দেশের আবহাওয়া লেবু চাষের উপযোগী।বিশেষ করে টবে লেবুর ফলন খুব ভাল হয় এবং অতি সহজেই।
কলমঃ লেবুতে বিভিন্ন ধরনের কলম হলেও সাধারণত গুটি কলমই বেশী জনপ্রিয়।খুব সহজেই লেবুর গুটিকলম করা যায়।গুটিকলম করতে হয় বর্ষাকালে।গুটিকলমের জন্য একটি একবছর বয়সী পেন্সিলের মত মোটা ডাল নির্বাচন করতে হবে।ডালের ডগা থেকে একফুট নিচে একটা গাঁটের গোঁড়ায় এক ইঞ্চি পরিমান ছাল ডাল থেকে তুলতে হবে। কাঠের মধ্যে যে পিচ্ছিল পদার্থ বিদ্যমান তা একটি শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে।অতঃপর গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ঐ জায়গা ভালভাবে ঢেকে দিতে হবে।তবে মাটি অবশ্যই কাদামাটির মত নরম করে নিতে হবে। একটি মোটা পলিথিন দিয়ে ঐ জায়গাটুকু ভালভাবে ঢেকে দুই দিকের মাথা সুতলী দিয়ে শক্ত করে এমন ভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন ভিতরে আলো বাতাস না ঢুকে।একমাসের মধ্যেই শিকড় গজিয়ে যায়।
কৃপ্র/ এম ইসলাম