কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ভোলা জালায় উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী হিসেবে গড়ে তোলা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে ইটভাটা। এতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের কেওড়া গাছ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইটভাটা স্থাপন করা হলেও নির্বিকার প্রশাসন। যদিও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, কাঠ পোড়ানোর ব্যাপারে ভাটার মালিকদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো।
১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ভোলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ কর্মসূচির আওতায় ভোলার চরফ্যাশন, লালমোহন ও মনপুরা উপজেলার প্রায় এক লাখ একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল গড়ে তোলা হয়। এর মাধ্যমে সিডর ও আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। এ উপকারের কথা চিন্তা না করেই বর্তমানে ভোলায় গড়ে ওঠা ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে বনের গাছ।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, জেলার সাত উপজেলায় ৭৫টি ইটভাটা রয়েছে। তবে বাস্তবে সক্রিয় ইটভাটার সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে নিয়ম ও নীতিমালার আলোকে বৈধ ইটভাটা আছে মাত্র আটটি। বাকিগুলো নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বন, ফসলি জমি ও আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে। কিছু কিছু ভাটার ৫০-১০০ গজের মধ্যেই রয়েছে হাটবাজার, ফলের বাগান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রায় সব ইটভাটাতেই কয়লার পরিবর্তে উপকূলীয় বেষ্টনীসহ বিভিন্ন বনের গাছ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলায় সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ শ্বাসকষ্টসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে।
চরফ্যাশনের চরমাইনকা ইউনিয়নে বন বিভাগের জমিতে স্থাপন করা হয়েছে টাটা ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা। তিন বছর ধরে এ ইটভাটায় বনের গাছ পোড়ানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। এ ব্যাপারে ভাটার মালিক জহির রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নতুন ভাটা তাই সনাতন চুল্লি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বছর ভাটার ইট দিয়েই নিয়ম অনুযায়ী আধুনিক চুল্লি তৈরি করা হবে।
একই ইউনিয়নে ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে গড়ে উঠেছে আকন ব্রিকস ও রাত্রি ব্রিকস নামে দুটি ইটভাটা। এসব ভাটায় বনের কেওড়া গাছই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।লালমোহনের লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের শাহ্ কামালের ইটভাটায়ও একই চিত্র দেখা গেল। নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে ভাটার কয়েকজন শ্রমিক জানান, বন থেকে নৌকা বোঝাই করে কেওড়া কাঠ ইট ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসা হয়। এ কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম।
এই উপজেলায় মানুষের বসতবাড়ির মাঝে গড়ে তোলা হয়েছে ইউসি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা। স্থানীয় বাসিন্দা রহমান জানান, ভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হলে এলাকার মানুষের দুর্ভোগ শুরু হয়। ধুলা ও ধোঁয়ায় ঘরে টিকে থাকা দায়।
পরিবেশবাদীরা জানান, অবৈধ ইটভাটা ও গাছ পোড়ানো বন্ধে একাধিবার মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হলেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ব্যাপারে ভোলার নাগরিক কমিটির প্রতিনিধি মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী বলেন, জেলায় অধিকাংশ ইটের ভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়টি প্রশাসনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছি। তবুও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর ইটভাটায় ৩০ হাজার ইট পোড়াতে ১৫০ মণ জ্বালানি কাঠ বা কয়লার প্রয়োজন। ইট বানানোর কাজে মাটি ব্যবহারের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। ভাটার মালিকরা কৃষকদের জমি ও মাটি বিক্রয় করার জন্য নানাভাবে বাধ্য করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০০৯ সালের সংশোধিত ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৮ নং ধারায় বলা হয়েছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষি জমি, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা প্রভৃতি জায়গায় ইটভাটা নির্মাণ নিষিদ্ধ। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ইটভাটা স্থাপনের জন্য কোনো প্রকার ছাড়পত্র বা লাইসেন্স দিতে পারবে না। এছাড়া কৃষি জমি, পাহাড় বা টিলা এলাকায় ইটভাটা স্থাপন কিংবা এসব এলাকা হতে মাটি সংগ্রহ করে এবং মজা পুকুর, খালবিল, খাঁড়ি দীঘি, নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, চরাঞ্চল, পতিত জায়গা কেটে মাটি সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
তবে জেলার কোনো ভাটায় ইট তৈরিতে এসব নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়া অনেক ইটভাটায় ড্রাম কেটে চিমনি তৈরি করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের গাছ। ইটভাটার মধ্যেই স মিল স্থাপন করে পোড়ানোর জন্য কাঠ চেরাই করা হচ্ছে।
ইটভাটায় বনের গাছ পোড়ানোর বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, জনবল সংকটের কারণে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এ সুযোগে বনের গাছ চুরি করে কেটে নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ভোলা জেলা প্রশাসক মোহা. সেলিম উদ্দিন বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চলতি মৌসুমে ইট পোড়ানোর কাজে যেসব ভাটা জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করছে, সেগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম