কৃষি প্রতিক্ষণ রিপোর্টঃ আশানুরূপ ফলন না পাওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ছিল কুমিল্লা সদর দক্ষিণের বাগমারা উত্তর ইউ.পির কৃষকরা। অনেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন বাপ-দাদার আদি পেশা কৃষি। এক পর্যায়ে অনাবাদী পড়ে থাকত শত শত বিঘা কৃষি জমি। এমনই এক প্রেক্ষাপটে একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিনের বদৌলতে বাগমারা এলাকা এই কৃষি সংকট কাটিয়ে এখন পরিনত হয়েছে আধুনিক কৃষির মডেল হিসাবে। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টরা কৃষি উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমনে আসছেন এই এলাকায় বাস্তবায়িত বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তি সরেজমিনে দেখতে। এখানকার কৃষকরা বানিজ্যিকভাবে ধানবীজ উৎপাদন করছেন, বানিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ করেছেন, উৎপাদন করছেন বিষমুক্ত ফল ও সবজি, চাষাবাদ হচ্ছে সম্পূর্ণ যন্ত্রের সাহায্যে, সাফল্য এসেছে বিদেশী ফল ড্রাগন ও স্টবেরী চাষাবাদে, নিয়মিত এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয় কৃষি উদ্বুদ্ধকরণ সভা।
সম্প্রতি ফেনীর সদর ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের তত্ত্বাবধানে কৃষকরা বাগমারা ইউ.পির দুতিয়াপুর কৃষি প্রযুক্তি গ্রাম পরিদর্শন করে গিয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আবদুল মোতালেব জানান, ২০১১ সালে অত্র এলাকায় তথা কেশনপাড় ব্লকে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন মোছলেহ উদ্দিন। এরপর থেকেই তাঁর পরামর্শ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমুল বদলে যেতে থাকে এই এলাকার কৃষি। এলাকার কৃষিতে সংযুক্ত হয় জৈবসার উৎপাদন ও ব্যবহার, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার, গুড়া ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার, এলসিসি মেশিন ব্যবহার, লোগো পদ্ধতি ধান চাষাবাদ, ধানে পার্চিং স্থাপন, সেচের পানি অপচয় রোধে সেচ নালায় পলিথিন ব্যবহার, নতুন নতুন জাতের ধান চাষাবাদ, খামার যান্ত্রিকীকরণ সহ বিভিন্ন আধুনিক লাগসই কৃষি প্রযুক্তির। এতে উৎপাদন ব্যয় কমার পাশাপাশি ফসলের অধিক ফলন নিশ্চিত হয় বিধায় আশানুরূপ মুনাফা পেয়ে বর্তমানে এলাকার কৃষকগন অধিক মনোযোগ দিচ্ছেন কৃষিতে।
জানা যায়, মোছলেহ উদ্দিনের উদ্বুদ্ধকরণ ও সার্বিক সহযোগীতায় গত ২০১৫ সালে দুতিয়াপুর কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি নামে ৪০ জন কৃষক নিয়ে একটি সমিতি গঠন করা হয় যার বর্তমান সদস্য প্রায় ১০০ জনের উপরে। এই সমিতির তত্ত্বাবধানে দুতিয়াপুর রেডিও স্টেশন সংলগ্ন মাঠে গত ২ বছর ধরে প্রায় ১৫ (পনের) একর জমিতে সম্পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদ হচ্ছে অর্থাৎ ধানের চারা লাগানো থেকে কর্তন ও সংগ্রহ সব করা হচ্ছে মেশিনে।
এলাকার শিক্ষিত যুবক মনির হোসেন সুমন জানান, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোছলেহ উদ্দিনের পরামর্শে গত কয়েক বছর ধরে ১০ একর জমিতে ব্রিধান-৫৮ ব্রিধান ৪৮ বিনা ধান-১৭ সহ বিভিন্ন আধুনিক নতুন জাতের ধানবীজ উৎপাদন করছেন তিনি, যা এলাকার কৃষকের চাহিদা মিটিয়ে কয়েকটি বীজ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানে সরবারাহ করছেন। ধানবীজ উৎপাদনের পাশাপাশি সুমন ৫ একর জমিতে অমৃত সাগর (বায়োটেক) জাতের কলা চাষাবাদ করছেন।
মোসলেহ উদ্দিনের পরামর্শে দক্ষিণ কুমিল্লায় প্রথমবারের মতো দুতিয়াপুরের কৃষক এরশাদুর রহমান ১ বিঘা জমিতে বানিজ্যিক ভাবে গোলাপ চাষাবাদ করে আশাতীত সাফল্য পেয়েছেন। এলাকায় গোলাপ চাষাবাদের এই সাফল্য দেখে কেশনপাড়ে কৃষক মিন্টু এবং নাওড়া গ্রামের কৃষক আহমেদ জামিল সেলিমও বানিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষাবাদ শুরু করছেন।
স্থানীয় কৃষক সূত্রে জানা যায়, কৃষি কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিনের উদ্বুদ্ধে গ্রামের কৃষকরা এখন ফসলের জমিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার, কীটনাশকের পরিবর্তে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ও পাচিং, বসত সবজি ও ফল চাষাবাদ করে অত্যান্ত সুফল পাচ্ছেন এতে শিক্ষিত যুবকেরাও আগ্রহী হচ্ছেন কৃষিতে।
আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কার্যকর লাগসই সম্প্রসারণের সুফল বাগমারা পেরিয়ে এখনো ছড়িয়ে পড়ছে বৃহত্তর কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায়। কৃষক-কৃষাণীর পাশাপাশি কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রশাসক ও বাংলাদেশ কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি আলহাজ্ব ওমর ফারুক, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার সহ কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বাস্তবায়িত এসব আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি পরিদর্শন করে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এলাকার এই কৃষি সাফল্য নিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জনাব গোলাম সারওয়ার বলেন কৃষি কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিনের পরামর্শ ও উদ্বুদ্ধে আমি নিজেও একজন কৃষক হয়ে গেলাম” ধান চাষাবাদের পাশাপাশি ১৫ একর জায়গায় আম, লিচু, পেঁপে, পেয়ারা, কুল, সফেদা, কদবেল, রামবুতান, ড্রাগনসহ বিভিন্ন জাতের ফল চাষাবাদ করছি ফলের সাথী ফসল হিসেবে আমার বাগানে চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজিও।
লালমাই বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মোঃআবদুল মমিন মজুমদার বলেন, কৃষি কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিনের আমার কলেজ সহ এলাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে নিয়মিত কৃষি বিষয়ক উদ্বুদ্ধকরণ করেন এতে অনেক শিক্ষার্থী পড়া-লেখার সাথে সাথে বসতবাড়ীতে ফল ও সবজি চাষাবাদ করছে।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, লাগসই প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব। আর সেই আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তিগুলিকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে তার নিজের কর্ম এলাকায় এটি সম্ভব করে তুলেছেন কৃষি কর্মকর্তা মোসলেহ উদ্দিন।
এলাকার সচেতন মানুষ এবং কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন মোসলেহ উদ্দিনের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে এলাকার কৃষিতে আধুনিকতার ছাপ লেগে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এছাড়াও নগরকৃষি ও ছাদ কৃষি নিয়ে কাজ করছেন মোসলেহ উদ্দিন এ খেত্রেও রয়েছে তার অসামান্য অবদান। দেশের প্রতিটি প্রান্তে মোসলেহ উদ্দিনের এর মতো আরো অনেক এমন গুণী কৃষি কর্মকর্তার প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
কৃপ্র/এম ইসলাম