কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ গত বছরের আগস্টে ভারি বর্ষণে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলো প্লাবিত হয়।এ সময়ে পানিতে প্রায় ৪৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল নষ্ট হয়ে যায়। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন এ অঞ্চলের কৃষকরা। এবার ক্ষতি পোষাতে চলতি বোরো মৌসুমে ধান আবাদের প্রস্তুতি শুরু করেছেন তারা।
জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এ অঞ্চলে প্রায় ৫২টি বিল আছে। পলি পড়ে ওই অঞ্চলের মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। গত বর্ষা মৌসুমে পানিতে প্রায় ৪৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যায়। ওই সময় পানিবন্দি হয়ে পড়ে অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ। এর পর ভবদহে শ্রী ও হরি নদীতে মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষামূলক চ্যানেল কাটার কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। একপর্যায়ে বাড়িঘর থেকে পানি নেমে যায়। তবে এখনো এ অঞ্চলের বিলগুলোয় পানি আটকে আছে। নদী দিয়েও পানি নামছে না।
স্থানীয়রা জানান, গত বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ বন্যায় মণিরামপুর উপজেলার ১৭ ইউনিয়নের মধ্যে ১৩ ইউনিয়নে আমন-আউশসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। উপজেলার কুলটিয়া, নেহালপুর, হরিদাসকাটি, ঢাকুরিয়া, শ্যামকুড় ও মনোহরপুর ইউনিয়নের কৃষকের ক্ষেতের ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। এ সময় বন্যাকবলিত এলাকায় তীব্র গোখাদ্য সংকটে গবাদিপশু সস্তায় বিক্রি করে দিতে হয় অনেককে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার তরফদার জানান, বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ বন্যা ও উজানের ঢলে উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ৬৮৫ হেক্টর কৃষিজমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ১৫২ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং ৬ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে আমন ছিল প্রায় ৭ হাজার ৭৫০ হেক্টর ও আউশ ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমির। এছাড়া সবজির মধ্যে পেঁপে ৭০ হেক্টর, মরিচ ২৫ হেক্টর, বিভিন্ন ধরনের সবজি ছিল প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমির এবং পান বরজের ক্ষতি হয় প্রায় ৬০ হেক্টর জমির। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬৭ কোটি ৮৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকরা চলতি বোরো মৌসুমে অধিক জমিতে ধান আবাদের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। এরই মধ্যে বীজতলা থেকে জমিতে চারা রোপণের কাজ করছেন তারা। বিলে জমে থাকা পানি সেচ দিয়ে বের করে বোরো ধান আবাদের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে এখনো উপজেলার প্রায় ৩০০ হেক্টর কৃষিজমি পানিতে নিমজ্জিত। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বোরো ধান আবাদের সময় থাকলেও এর মধ্যে নিমজ্জিত এলাকার পানি নিষ্কাশন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিস।
কৃষকরা জানান, বন্যায় অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। তার পরও আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিলপাড়ের কৃষক আব্দুল হালিম জানান, বন্যার কারণে তার প্রায় চার বিঘা সবজি ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। চলতি বোরো মৌসুমে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তিনি প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো ধান ও দুই বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করছেন। কাজির গ্রামের শাহাবুদ্দিন জানান, বন্যায় তার প্রায় তিন বিঘা জমির আমন ধান নষ্ট হয়। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করছেন।
অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, এ ইউনিয়নে বিলের উপরের অংশের জমিতে বোরোর চাষ হচ্ছে। এলাকায় এখন খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বোরোর আবাদ না হলে এই সংকট তীব্র হবে। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বোরো মৌসুমে এ উপজেলার ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছিল। অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলায় কৃষক আছেন কমপক্ষে ৫০ হাজার। ওই অঞ্চলে গড়ে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়।
অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ছামদানী বলেন, বিলের পানি সেচে বোরো চাষ করতে আমরা কৃষককে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছি। গত বছর ভবদহ এলাকায় যে পরিমাণ জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছিল, এবার তার ৮০-৯০ ভাগ জমিতে বোরো চাষ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। কেশবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র বলেন, বিল থেকে পানি সরানোর জন্য সম্প্রতি পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। এছাড়া কৃষকরা ছোট বিলগুলোয় পানি সেচে বোরো চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষকই বোরো আবাদে নেমে পড়েছেন। আমরা তাদের নানাভাবে সহায়তা করছি।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করা এবং বিলগুলোয় বোরো ধানের চাষ যাতে হয়, সেজন্য আমরা তিনটি এক্সক্যাভেটর দিয়ে শ্রী ও হরি নদীর মধ্যে পাইলট চ্যানেল কাটার দাবি তুলেছিলাম। কিন্তু একটি মাত্র এক্সক্যাভেটর দিয়ে খননকাজ করা হয়েছে। ফলে এলাকার প্রায় সব বিলে এখনো পানি রয়েছে। তার পরও কৃষকরা সেচ দিয়ে বোরো ধানের আবাদে নেমে পড়েছেন।
পাউবোর যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, শ্রী ও হরি নদীতে পাইলট চ্যানেল কাটার ফলে ভবদহ অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায় পানি নেমে গেছে। নদীগুলো কচুরিপানায় ভরে আছে। এ কারণে নদী দিয়ে ধীরে ধীরে পানি নামছে। তিনি বলেন, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে আগামীতে এই অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে না।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম