কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর, আবুপুর, চর মেমানিয়া ও হিজলা-গৌরনদী সংলগ্ন মেঘনায় প্রায় সময়ই ইলিশের ঝাঁক দেখা যায়। যদিও ইলিশের অভয়াশ্রম নয় এগুলো। কোনো ধরনের বিধিনিষেধ না থাকায় প্রজনন মৌসুমেও এসব এলাকায় ইলিশ ধরছেন জেলেরা। ধরা পড়ছে জাটকাও।
হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জের নদীতে নিয়মিত ইলিশ ধরেন চর মেমানিয়ার নূর মাঝি। ইলিশের ভালো প্রাপ্যতার কথা জানান এ জেলে। এসব নদী থেকে সংগৃহীত ইলিশ নগরীর পাইকারি মত্স্য অবতরণ কেন্দ্রে বিক্রি করেন আরেক জেলে রুস্তুম মিয়া। যদিও এলাকাগুলোয় বছরে অন্তত দুই মাস ইলিশ ধরা বন্ধ রাখলে মাছটির উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করছেন খোদ মত্স্য কর্মকর্তারাই।
মত্স্য অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের মত্স্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জের নিম্ন মেঘনা, ধর্মগঞ্জ, লতা ও কালাবদর নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য বেড়েছে। হিজলার ধুলতলা থেকে হরিনাথপুর ও মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাট থেকে বরিশাল সদরের ঝুনাহার পর্যন্ত চার কোনা বিশিষ্ট এ ৬০ কিলোমিটার এলাকা মত্স্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতি ১০০ মিটার জাল ফেলে ঘণ্টায় ৫০টির বেশি ইলিশ ধরা পড়লে এবং পানির গুণগত মান ভালো হলে ওই নদী ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচিত হয়। ইলিশের চারটি বিচরণক্ষেত্রকে এখন পর্যন্ত অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। অভয়াশ্রমগুলোর একটি হলো, চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদী অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা। ভোলা জেলার মদনপুর বা চর ইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার ও ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্তও অভয়াশ্রমের অন্তর্গত। এছাড়া শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া-ভেদরগঞ্জ উপজেলা অংশে নিম্ন পদ্মার ২০ কিলোমিটার ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকাও অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিদ্যমান এসব অভয়াশ্রমের আশপাশে শাখা নদীতেও ইলিশের প্রাপ্যতা বেড়েছে। ইলিশের নতুন বিচরণক্ষেত্রের তথ্য দিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকও। তারা দেখিয়েছেন, বরিশাল জেলার পুরাতন হিজলার পাশাপাশি শরীয়তপুর জেলার বাংলাবাজার এলাকায় অভয়াশ্রমের মতোই ইলিশের রেণু উৎপাদন হচ্ছে। পূর্বঘোষিত পদ্মা ও মেঘনা এলাকার অভয়াশ্রমের পাশেই এর অবস্থান।
গত বছর ওই এলাকার জেলেদের ওপর জরিপ চালিয়ে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফিশারি কনফ্লিক্টস ইন হিলশা স্যাংচুয়ারিজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তারা। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেন, জেলেদের মধ্যে এসব বিচরণক্ষেত্রে ইলিশ ধরার প্রতিযোগিতা বাড়ছে। স্বাভাবিক সময়ের মতোই নিষিদ্ধ সময়েও নদীতে জাল ফেলছেন জেলেরা। সাধারণ নৌকা নিয়ে মাছ ধরা জেলেদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও এর বাইরে থেকে যাচ্ছেন যন্ত্রচালিত নৌযান ব্যবহারকারীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মায়ও ইলিশের বিচরণ বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে এ বিচরণক্ষেত্র গড়ে উঠলেও গত বছর তা নজরে এসেছে। একইভাবে ইলিশের বিচরণ বেড়েছে যমুনার বিভিন্ন স্থানেও। মাছটির উৎপাদন বাড়াতে এ দুটি স্থানও অভয়াশ্রম ঘোষণার সময় এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইলিশের বিচরণক্ষেত্র সম্প্রসারণের বিষয়টিতে একমত পোষণ করেন মত্স্য অধিদপ্তরের জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবিএম জাহিদ হাবিবও। তিনি বলেন, আগে চারটি জেলার মাত্র ২০টি উপজেলায় ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম থাকলেও এখন তা ২৯টি জেলার ১৫০টি উপজেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। মাছটির উৎপাদন বাড়াতে নতুন অভয়াশ্রম চিহ্নিত করার পাশাপাশি সেগুলোর সুরক্ষার কাজও চলছে।
ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে নতুন বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে সেগুলোকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইলিশের নতুন বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গবেষণা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এগুলোর যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থাও নিতে হবে। জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে ইলিশ উৎপাদন আরো বাড়বে।
মত্স্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. লিয়াকত আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, ইলিশ উৎপাদন ও আহরণ বাড়াতে সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রজনন পয়েন্ট ও অভয়াশ্রম এলাকা প্রয়োজনে বাড়াতে হবে। জেলে, স্থানীয় প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সুরক্ষিত করতে হবে এসব অভয়াশ্রম।
বিদ্যমান অভয়াশ্রমগুলোয় বছরের নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকায় কয়েক বছর ধরেই দেশে মাছটির উৎপাদন বাড়ছে। মত্স্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০০১-০২ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছর উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার টনে। পরের অর্থবছর তা আরো দুই হাজার টন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৭ হাজার টনে। আর গত অর্থবছর দেশে ইলিশ উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৯৪ হাজার টন।
প্রজনন পয়েন্ট ও অভয়াশ্রমে নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় প্রতি বছরই ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন মত্স্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ। তিনি বলেন, ইলিশের এ উৎপাদন আরো বাড়াতে অভয়াশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। উৎপাদন বাড়াতে বৈজ্ঞানিক সব পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আরো একটি অভয়াশ্রম দ্রুতই ঘোষণা করা হবে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম