ড. মো. হুমায়ুন কবীর: বিশ্বে দানাদার শস্যের মধ্যে গমের অবস্থান প্রথম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধানের পরে গম হলো দ্বিতীয় প্রধান দানাদার জাতীয় ফসল। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় ব্লাস্ট জাতীয় ছত্রাকের আক্রমণের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ধরা পড়ে। সেটি ধান, গমহ দানাজাতীয় ফসলে আক্রমণ করে বলে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে তার ব্যাপক আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। পরে সেখান থেকে অন্যান্য গম উৎপাদনকারী দেশ যেমন- চিলি, প্যারাগুয়ে ইত্যাদি স্থানে এর বিস্তার ঘটতে থাকে।
বিজ্ঞানীগণ গমের এ ব্লাস্ট রোগটির জন্য ছত্রাকের যে রোগ জীবাণু বা প্যাথোজেন সনাক্ত করেছেন সেটি হলো- গধমহধঢ়ড়ৎঃযব ড়ৎুুধব (ংুহ. চুৎরপঁষধৎরধ ড়ৎুুধব)। তবে আশার কথা হলো এটি ধানের ব্লাস্ট রোগের প্যাথোজেন বহন করলেও তা আক্রান্ত গম থেকে ধানে সরাসরি সংক্রমিত হয় না। গমের আবাদ বাংলাদেশে খুব বেশিদিন আগের নয়। আশির দশক থেকেই কিছু কিছু গমের আবাদ হতে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় সেসময় গম ছিলনা। আমরা গ্রামে ছোটবেলায় দেখেছি, গম, আটা, রুটি, ময়দা ইত্যাদি ছিল গরীব মানুষের খাবার। তখন এগুলো যারা খেত তাদেরকে খুব অবহেলার চোখে দেখা হতো। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, কিংবা রেশন, ত্রাণ ইত্যাদি কাজে গম সরবরাহ করার রেওয়াজ ছিল।
কিন্তু আস্তে আস্তে মানুষ যতই স্বাস্থ্য সচেতন হতে লাগল ততই বাড়তে থাকল গমের কদর। তাছাড়া বাংলাদেশের আবহাওয়া গম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বোরো ধান ও সবজি কর্তৃক অধিকৃত হওয়ায় গম চাষের জমি আবারো কমে যাচ্ছে। সেজন্য দেশের খাদ্য চাহিদার জন্য গম এখন ক্রমশ আমদানি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের মূল কৃষি উন্নয়নের পরিপন্থি।
কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে গম আবাদের জমির পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর। এর বেশিরভাগই আবাদ হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিামাঞ্চলের পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, বরিশাল ও ভোলা জেলাসমূহে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও গম আবাদে ব্লাস্ট রোগটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এক সমীক্ষায় প্রকাশ, গত ২০১৬ সালে মোট গমের আবাদী জমির ভিতর প্রায় ১৫% জমি অর্থাৎ ১ লাখ ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমি মারাত্মকভাবে এ ব্লাস্ট ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছিল।
এ ছত্রাক বীজ থেকে সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। তাছাড়া গমের গাছ থেকে যখন শীষ বের হওয়া শুরু হয় তখন এটি দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। পরে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সমগ্র ফিল্ডে তা ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত গাছ দ্রুত ঝলসে যেতে থাকে এবং শুকিয়ে যায়। পরবর্তীতে শীষ মুড়িয়ে গিয়ে দানা বাধতে পারে না এবং দানা বাধলেও তা আকারে অসমতাপূর্ণ ও ছোট হয়ে যায়। এতে ফলনও মারাত্মকভাবে কমে যায়। আক্রান্ত গাছ থেকে এমনকি আক্রান্ত মাঠ থেকে পরবর্তী বছরের জন্য আবাদের জন্য বীজ সংরক্ষণ করলে তা বীজের মাধ্যমে আবারো ছড়ায়। কাজেই এ অর্থকরী, উচ্চ খাদ্যমূল্য সম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ ফসলটি রক্ষার্থে দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
আমরা জানি, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’। সেজন্য এ ছত্রাক কোন গম ক্ষেতে একবার আক্রমণ করে ফেললে তা এত দ্রুত গতিতে ছড়ায় যে, তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেজন্য আক্রান্ত গম গাছসমেত উপড়ে ফেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আক্রান্ত এলাকার বীজ রাখা যাবেনা। বীজ বপনের পূর্বে শোধন করে নিতে হবে। একবার যে জমিতে গম চাষ করা হবে সে জমিতে পরের কমপক্ষে ২-৩ বছর আর গম আবাদ করা যাবে না।
সেসব জমিতে অন্য ফসল দিয়ে শস্য ক্রম ও শস্য আবর্তন করতে হবে। গতবছর কিছু এলাকায় ব্লাস্টের আক্রমণের পরে সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষি বিভাগ তাদের সেসব জমিতে আর এবছর গম আবাদ না করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা সে পরামর্শ না শোনায় সেসব এলাকায় এবারো ব্লাস্টের ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে যা গণমাধ্যমে ফলাও হয়েছে। যার ফলে এবারেও অনেক আক্রান্ত গমের জমির গমফসল পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছে। কাজেই তুলনামূলক কম মূল্যে ভাতের পরিবর্তে বিকল্প স¦াস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসম্মত জাতি গঠনে নিরাপদে গম আবাদের বিকল্প নাই। এখন গমের মৌসুম চলছে। সেজন্য ব্লাস্ট ছত্রাক ঠেকাতে উপরোক্ত ব্যাবস্থা এখনই নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক: কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
কৃপ্র/এম ইসলাম