কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত ঘেষা এলাকায় অবস্থিত সাগর নয়, প্রাকৃতি সৌন্দর্যের অপূর্ব জলাশয়ের নাম রামসাগর। সৌন্দর্যের কারণে এখানে অসংখ্য মানুষ ঘুরতে আসে। সরকার এই রামসাগরকে পর্যটন এলাকা হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলে রাজস্ব আয়সহ দেশের পর্যটনে অসংখ্য পর্যটকদের ভিড় বাড়বে।
রামসাগর শুধু ঐতিহাসিক কীর্তিই নয়-এ প্রাকৃতিক শোভা ও সৌন্দর্যের লীলাভূমিও। দীঘির পাড়ের উচ্চ টিলার উপর অবস্থিত সুন্দর মনোরম ডাকবাংলোটি দেশী ও বিদেশী অসংখ্য কৌতুহলী পর্যটকের নিকট যেমন স্বপ্নীল আকর্ষণ, তেমনি অনেক রসিক ব্যক্তির নিকেতনও বটে! এই দীঘির মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ পরিবেশে বিনোদনের জন্য সারা বছরে অগণিত মানুষ ছুটে আসেন। তারা অনেকে ঘুরে বেড়ান কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাবার জন্য। মরীচিকার হাতছানি এইভাবে এসেই যেন থেমে গেছে সবুজের অন্তরে। দীঘির নাম রামসাগর। সাগরের পানির মত নীল পানি বক্ষে ধারণ করে হ্রদের বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে এর অবস্থান। সাগরের মতো বিশাল না হলেও হ্রদের মতো বড়। দিনাজপুর শহর হতে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে এই দীঘির পানিতে মিশে রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস আর কিংবদন্তী।
দিনাজপুরে ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান রামসাগর। দীঘির চারপাশ ঘিরে রয়েছে লাল মাটির ছোট ছোট টিলা। এর পরেই সবুজ প্রান্তর। তটভূমিসহ দীঘির আয়তন ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার ৩১ মিটার, প্রস্থ ৩ শত ৬৪ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। রামসাগর শুধু দিনাজপুরের নয়, বাংলাদেশের দীঘিগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই দীঘিকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু কিংবদন্তী ও উপাখ্যান। ইতিহাসের চেয়ে সাধারণ মানুষ কিংবদন্তীকেই বিশ্বাস করে বেশী।
কিংবদন্তী অনুসারে পুরাকালে এই অঞ্চলে এক রাজা ছিলেন নাম প্রাণনাথ। সুশাসক ও প্রজাপ্রিয় রাজা বলে তার দেশ-জোড়া খ্যাতি ছিল, আর ছিল অফুরন্ত ধনসম্পদ। কিন্তু মনে ছিল না শান্তি। কারণ রাজার ছিল না কোন পুত্র সন্তান। বহু যাগযজ্ঞ ও দান-দক্ষিণার ফলে অবশেষে দৈবকৃপায় রাজার ঘরে জন্ম নিল এক পুত্র সন্তান। নাম রাখা হলো রামনাথ। যুবরাজ রাম যখন যৌবনে পদাপর্ণ করে। তখন দেশ জুড়ে নেমে আসে প্রকৃতির নিষ্ঠুর তান্ডব।
শুরু হলো একটানা অনাবৃষ্টি ও খরা। গোটা মৌসুমে একফোঁটা পানিও পড়ল না আকাশ হতে। অনাবাদি রইল মাঠ। ফসল বা শস্য পাওয়া গেল না একমুঠো। দেশ জুড়ে দেখা দিল প্রচন্ড খাদ্যাভাব। অনাহারে মারা যায় শত শত মানুষ। জনগণের জন্য খুলে দেয়া হলো রাজভান্ডার। এতে খাদ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও দেখা দিল পানীয় জলের অভাব। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি ও খরায় খাল-বিল, দীঘি-নালা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। একফোটাও পানি নেই কোথাও।
রাজ্য জুড়ে শুরু হলো পানির জন্য আহাজারি। এমন পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন এক বিরাট দীঘি খনন করার। শুরু হল দীঘি খনন। হাজার হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে খনন করে এক সাগরতূল্য দীঘি। কিন্তু এত গভীর করে খনন করা সত্ত্বেও দীঘির বুকে উঠলো না একফোঁটা পানি। হতাশা ও দুর্ভাবনায় বৃদ্ধ রাজা আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন। তার মৃত্যুর আশঙ্কায় ঘরে ঘরে শুরু হলো কান্নার রোল। একদিন রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন, তার একমাত্র পুত্র রামকে খনন করা দীঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে। রাজার মুখে স্বপ্নাদেশ শুনে সারা রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া।
কিন্তু রাজপুত্রের মনে কোন বিকার নেই। নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রজাদের জীবন রক্ষা করতে রাজকুমার অবিচল। তার নির্দেশক্রমে দীঘির মধ্যস্থলে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করা হলো। এর পর গ্রামে গ্রামে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রজাদের জানিয়ে দেয়া হলো, কাল ভোরে দীঘির বুকে পানি উঠবে। পরদিন ভোর না হতেই রাজবাড়ীর সিংহদ্বার খুলে গেল। বেজে উঠল কাড়া-নাকাড়া। হাতির পিঠে চড়ে শুভ্রবসন পরিহিত যুবরাজ যাত্রা শুরু করলেন সেই দীঘির দিকে। দীঘির পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দীঘির তলদেশ হতে অজস্র ধারায় পানি উঠতে লাগল। চোখের পলকে পানিতে ভরে গেল বিশাল দীঘি। পানিতে ভেসে রইল রাজকুমারের সোনার মুকুট। যুবরাজ রামের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে দীঘির নাম রাখা হলো রামসাগর।
দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ কর্তৃক রামসাগর দীঘি খনিত হয়। রামনাথ ছিলেন দিনাজপুর রাজবংশের শ্রেষ্ঠতম নৃপতি। তিনি ১৭২২ খৃষ্টাব্দ হতে ১৭৬০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দিনাজপুরে রাজত্ব করেন। দিনাজপুর রাজবংশের ইতিহাসের মতে ১৭৫০ হতে ১৭৫৫ খৃষ্টাব্দে মধ্যে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে রামসাগর দীঘি খনিত হয়। রাজা রামনাথের শক্তি ও সম্পদের অন্যতম অতূল্য কীর্তি হয়ে খনিত হয় দেশবিখ্যাত রামসাগর দীঘি।
রামসাগরে একটি পাথরঘাটা রয়েছে। যা প্রায় ৬ হাজার বর্গফুট আয়তকারভাবে নির্মিত ঘাটটির সঙ্গতি দীঘির বিশালতার সঙ্গে বিশেষ সামঞ্জস্যপূর্ণ। আকারে দীঘিটি যেমন বিরাট, সে অনুপাতে বিরাট দীঘির ষান বাঁধা ঘাটটিও। বৃহৎ বৃহৎ সাইজ করা বেলে পাথর দ্বারা ঘাটটি নির্মিত। পাথরের সøাবগুলো আকার ও আকৃতিতে সব সমান সাইজের নয়। অপেক্ষাকৃত ভূমিকায় পাথরগুলো কোন কোনটির আকার র্৩ র্৬র্ র্১, র্৩র্ র্৬র্ বর্গফুট পর্যন্ত দৃষ্ট হয়। এসব পাথর দিয়ে ঘাটটির উপরিভাগ আগাগোড়ামন্ডিত।
রামসাগরের উত্তর দিকে পাড়-ভূমির বহিরাংশে একটি অর্ধভগ্ন ভবন নানা কৌতুহল জাগিয়ে রেখেছে। কেউ বলে এটি দেব মন্দির। কারও মতে এ রাজকীয় বিশ্রামাগার। বলাবাহুল্য যারা দীঘি দেখেতে আসেন তাদের অনেকেই পরম কৌতুহলপরবশ হয়ে এই ভগ্ন সৌধটিও দেখে যান।
শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নির্মিত অন্যান্য মন্দিরের ভূমি নক্সা বিশেষ করে বিখ্যাত কান্তমন্দিরের স্থাপত্য কাঠামোর সঙ্গে এই মন্দিরের স্থাপত্য কাঠামো প্রায় অভিন্ন বা অতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। সৌধের মধ্যস্থিত গর্ভগৃহটি এর মন্দির হিসাবে প্রকৃষ্ট প্রমাণ। খুব সম্ভব দীঘি খনন সমাপ্ত হওয়ার পর এর উদ্বোধনকালে প্রচলিত নিয়মানাসারে মন্দিরটিও নির্মিত হয়। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে মন্দিরটি ৬র্০ ৬র্০ বর্গফুট র্৩ র্৮র্ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়াললোপরি নির্মিত সৌধটি একাধিক তলাবিশিষ্ট ছিল বলে মনে হয়। বর্তমানে সৌধোপরি কোন ছাদ বা চূড়া নাই। পক্ষান্তরে সৌধটি মন্দিরের পরিবর্তে রাজকীয় বিশ্রামাগার রূপে জনশ্রতিতে সমধিক পরিচিত। লোককথায় এর অপর নাম ‘বারদুয়ারী’ অথবা ‘লুকোচুরি খেলার ঘর’। লোক বিশ্বাসে রাজা-রাণী বা রাজপরিবার যখন রামসাগরে প্রমোদ বিহারে আগমন করতেন তখন তাদের বিশ্রামের নিমিত্ত এই গৃহ ব্যবহৃত হতো। অলিগলি সদৃশ্য অট্টালিকাটির কক্ষ হতে কক্ষান্তরে রাজপরিবারের শিশুরা লুকোচুরি খেলা করত বলে এর অপর নাম ছিল ‘লুকোচুরি খেলাঘর’। অনেকগুলো দরজাযুক্ত হওয়ার কারণেও জনসাধারণের নিকট এর অন্য নাম ছিল ‘বারদুয়ারী’ প্রসাদ।
রামসাগর দিনাজপুর বন বিভাগের আওতায়, সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বন বিভাগ এখানে ৪শ’ প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২শ’ প্রজাতির উন্নতমানের গোলাপ। দীঘির চারিপাশের প্রায় আড়াই কিলোমিটার সড়কের দুই ধারে লাগানো হয়েছে দেবদারু, ঝাউ ও মুছকন্দ ফুলের গাছ। দুই একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে কৃত্রিম শিশুপার্ক। এই পার্কে জিরাপ, বন মানুষ, ভাল্লুক, হাতিসহ প্রায় ২০টি প্রাণীর প্রমাণ সাইজ প্রতিকৃতি রয়েছে।
রামসাগরকে পর্যটনের আওতায় নিয়ে আসবার পর বন বিভাগের ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গড়ে উঠেছে একটি আধুনিক দ্বিতল ডাকবাংলোসহ ৭টি পিকনিক কর্ণার। রয়েছে ক্যাফেটোরিয়া, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ। রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিকট রামসাগরকে আরও আকৃষ্ট করার জন্য ৬কোটি টাকার একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, পানির উপর উন্নতমানের ক্যাফেটেরিয়া, ৪০ আসন বিশিষ্ট ডরমিটরি, মিনি ট্রেন প্রভৃতি। রামসাগরে প্রতিবছর প্রায় ২ লক্ষ দর্শনার্থী ও পর্যটক আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এতে রাজস্ব আয় হবে প্রায় ৫ কোটি টাকার মতো। শহর হতে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামসাগরে যাওয়ার জন্য কোন বাস সার্ভিস নেই। একমাত্র ভরসা রিকশা ও লক্কর ঝক্কর টেম্পু। ভাড়া ৩০/৪০ টাকার মতো।
সুত্রঃ বাসস / রিপোর্টঃ রোস্তম আলী মন্ডল / কৃপ্র/এম ইসলাম