কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ হাঁস পালনে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন সেভাবে পড়ে না। বাড়তি খাবারের ঝক্কিও কম। পুকুর-জলাশয়েই নিজের খাবার খুঁজে নেয়। হাঁসকে তাই দেখা হয় অতিদরিদ্র গ্রামীণ নারীদের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে। মুরগির পর মাংস ও ডিমের দ্বিতীয় বৃহত্ উত্সও এটি। তার পরও দেশে হাঁস পালন সেভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হিসেবে হাঁসের বিচরণক্ষেত্র পুকুর-জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাঁস পালনে দেশের আদর্শ জেলাগুলোর অন্যতম ময়মনসিংহ। পারিবারিকভাবে ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে জেলাটিতে গড়ে উঠেছে হাঁসের ছোট-বড় খামার। ময়মনসিংহ সদর উপজেলাও এর বাইরে নয়। হাঁসের খামার রয়েছে, উপজেলার এমন সাতটি গ্রামের খামারিদের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। সম্প্রতি প্রকাশিত জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারীদের ৮১ শতাংশই হাঁস চাষের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন হাঁসের বিচরণক্ষেত্র ও নিজস্ব পুকুর না থাকার কথা।
হাঁস পালনের জনপ্রিয়তা কমার তথ্য রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরিসংখ্যানেও। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছর জেলায় হাঁসের খামার ছিল ৩১২টি। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২৭০টিতে। এখন নতুন করে কেউ আর হাঁস পালনে আগ্রহী হচ্ছেন না। উল্টো অনেকে খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আফতাব উদ্দিন বলেন, একসময় জেলায় হাঁসের খামারির সংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়লেও কয়েক বছর ধরে এতে পরিবর্তন এসেছে। খামারের সংখ্যা বাড়ছে তো নয়ই, কোথাও কোথাও কমছে।
ময়মনসিংহের মতোই অবস্থা হাঁস পালনের জন্য পরিচিত অন্যান্য জেলারও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, আটপাড়া, মদন, খালিয়াজুরী উপজেলার হাওড়পাড়ের অন্তত ৫০টি গ্রামে একসময় গড়ে উঠেছিল দেড় শতাধিক ছোট-বড় হাঁসের খামার। পুকুর ও মুক্ত জলাশয় সংকটে দিন দিন কমে আসছে খামারের সংখ্যা।জলাশয়গুলোর পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে চাষীদের মধ্যে হাঁস পালনে অনাগ্রহ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) সাবেক পরিচালক (উত্পাদন) ডা. অরবিন্দ কুমার সাহা। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি হাঁসের খাদ্যের প্রয়োজন হয় প্রতিদিন ১৬০ গ্রাম। তবে হাওড়, বিল, নদী এলাকায় হাঁসের খামারে অতিরিক্ত খাদ্য সেভাবে প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিক উত্স থেকেই মাছ, ঝিনুক, শামুক, পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। পুকুরে হাঁস চাষ করলে সার ও মাছের খাদ্য ছাড়াই মাছ উত্পাদন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু গত কয়েক বছরে জলাশয়গুলোর পরিবেশ নষ্টের কারণে হাঁস পালন এখন আর লাভজনক হচ্ছে না। হাঁস পালন জনপ্রিয় করতে তাই জলাশয়গুলোর স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
ডিএলএসের তথ্য বলছে, দেশে পুকুরের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অধিকাংশ জেলায় আর বাণিজ্যিক খামারে হাঁস পালন হচ্ছে না। এখনো যেসব জেলায় খামারে হাঁস পালন হচ্ছে, তার মধ্যে আছে সিলেট বিভাগের হাওড় অঞ্চল এবং খুলনা, রাঙ্গামাটি, মুন্সীগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী ও নওগাঁ। কয়েক বছর ধরে ময়মনসিংহে মাছ চাষ বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমন্বিত হাঁস পালনও শুরু হয়। কিন্তু জেলার অধিকাংশ পুকুরে প্রাকৃতিক ভারসাম্য না থাকায় এসব জলাশয়েও আগের মতো আর হাঁস পালন হচ্ছে না। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে এখন হাঁস উত্পাদন হচ্ছে প্রায় পাঁচ কোটি। হাঁস উত্পাদন ধরে রাখতে সরকারিভাবে ১০টি হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে ১২-১৫ হাজার একদিনের হাঁসের বাচ্চা সরবরাহ করা হচ্ছে। খামারিদের চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা সরবরাহ দিতে হ্যাচারির সংখ্যা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় হাঁস প্রজনন খামারের প্রধান মো. আনোয়ারুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, হাঁস পালনে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়া রোগের প্রাদুর্ভাবও তুলনামূলক কম। ফলে মাংস ও ডিম উত্পাদনে খামারিদের কাছে একসময় জনপ্রিয় ছিল হাঁস পালন। কিন্তু প্রাকৃতিক খাবারের অপর্যাপ্ততার কারণে হাঁস পালনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তবে সরকারিভাবে খামারিদের কাছে পর্যাপ্ত একদিনের বাচ্চা সরবরাহে সচেষ্ট রয়েছে ডিএলএস। এজন্য বাচ্চা উত্পাদনকারী হ্যাচারির সংখ্যা ১৭তে উন্নীত করা হচ্ছে। পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবনেও জোর দেয়া হচ্ছে।
কৃপ্র/এম ইসলাম