কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদী ও খালে আহরণ নিষিদ্ধ কাঁকড়া শিকারের হিড়িক পড়েছে। শিলা প্রজাতির কাঁকড়া আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বন বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে শিলা কাঁকড়া আহরণ করছেন জেলেরা। চলতি প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া শিকারের ফলে এবার সুন্দরবন থেকে শিলাসহ অন্যান্য প্রজাতির কাঁকড়া বিলুপ্তির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবনের মংলা, রামপাল, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, দাকোপ, কয়রাসহ সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার বিপুলসংখ্যক বনজীবী বছরজুড়ে শিলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব বনজীবী সরকারি রাজস্ব দিয়ে বন বিভাগের কাছ থেকে বৈধ পারমিট নিয়ে সুন্দবনের কাঁকড়া ধরেন। তবে প্রতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাস কাঁকড়ার ভরা প্রজনন মৌসুম হওয়ায় এ সময় বন বিভাগ কাঁকড়ার বংশবিস্তারে জন্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদ-নদীর শিলা কাঁকড়া দলে দলে সমুদ্রে ও বড় নদীতে বাচ্চা ফুটানোর জন্য আসে। যে কারণে সুন্দরবনে এ দুই মাসে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ শিলা কাঁকড়া পাওয়া যায়। এ কারণে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বেশি লাভের আসায় অসাধু মহাজনরা গরিব জেলেদের অগ্রিম দাদনের টাকা দিয়ে সুন্দরবনের নদ-নদীতে শিলা কাঁকড়া আহরণ করতে পাঠান। আর ওই মহাজনরা বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ম্যানেজ করে শেষ ভাগে এসেও অবৈধ উপায়ে ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়াসহ সব ধরনের কাঁকড়া শিকার করেন।
অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের সঙ্গে আঁতাত করে নামমাত্র মাছ শিকারের পাস নিয়ে অসাধু জেলেরা দেদার কাঁকড়া শিকার করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে ও বনজীবী জানান, চুক্তি করে বন বিভাগের স্টেশন অফিস থেকে ঘুষ দিয়ে সাদা মাছের পারমিট নিলেও বনে গিয়ে শিলা কাঁকড়া শিকার করেন জেলেরা। এছাড়া টহলরত ফরেস্টারদের সঙ্গেও চুক্তি থাকে। যে কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বনে প্রবেশ করার আগেই জেলেদের খবর জানিয়ে দেয়া হয়। এ সময় জেলেরা গভীর বনের খালে লুকিয়ে থাকেন। এভাবেই সুন্দরবনে শিলাসহ অন্য সব প্রজাতির কাঁকড়া ধরা অব্যাহত রয়েছে। আবার অনেক জেলে পাস পারমিট না নিয়েই বন বিভাগকে ম্যানেজ করে বনে প্রবেশ করে দেদার শিলা কাঁকড়া ধরছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মংলা ও শরণখোলার কয়েকজন কাঁকড়া আড়তদার বলেন, বর্তমানে ডিমওয়ালা শিলা কাঁকড়া ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে। এসব কাঁকড়া ঢাকায় ২ হাজার থেকে আড়াই টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়। তবে এ দুই মাস শিলাসহ অন্য সব প্রজাতির কাঁকড়া ধরা নিষেধ, এটা জানার পরও কেন কাঁকড়া কিনছেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে এক আড়তদার বলেন, আমার মতো অনেক কাঁকড়া ব্যবসায়ী এ সময় কাঁকড়া কিনছেন, তাই আমিও কিনছি। বন বিভাগ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় এভাবে কাঁকড়া শিকার করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সুন্দরবনে প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে কাঁকড়া শিকারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকার বা বন বিভাগ কেউই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড এ ম্যানগ্রোভ বনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় মোটেই আন্তরিক নয়। শিকার নিষিদ্ধ সময়ে ডিমওয়ালা অন্য সব প্রজাতির পাশাপাশি রফতানি পণ্য শিলা কাঁকড়া নির্বিচারে আহরণ করার ফলে কাঁকড়া ভাণ্ডারখ্যাত সুন্দরবনে কাঁকড়ার বিলুপ্তি ঘটবে। এতে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাবসহ আন্তর্জাতিক বাজারে বিপুল চাহিদা থাকা শিলা কাঁকড়া নামে রফতানি পণ্যটিও হুমকির মুখে পড়বে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে দ্রুত শিকার নিষিদ্ধ প্রজনন মৌসুমে সব ধরনের কাঁকড়া আহরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে সরকার ও বন বিভাগকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে প্রজনন মৌসুম শুরুর আগেই কাঁকড়া আহরণ বন্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) মেহেদীজ্জামান বলেন, কাঁকড়া শিকার বন্ধে বন বিভাগ অভিযান চালাচ্ছে। গত শনিবারও একটি ট্রলারে প্রায় ১০ মণ শিলা কাঁকড়াসহ দুই জেলেকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর আদালত তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। অবৈধ উপায়ে কাঁকড়া শিকারে জেলেদের সঙ্গে সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত থাকলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় বন বিভাগ তত্পর রয়েছে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম